Saturday, December 14, 2019

ক্যাবের বিরোধ

চাহিবি উতরে বলিবি দখিণে যাইবি পূরব মুখে
গোপন পিরিতি গোপন রাখিবি থাকিবি পরম সুখে।

নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন আনার পরে, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং পশ্চিমবঙ্গ সহ দেশের বিভিন্ন অংশে যে বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়েছে, সেরকম যে হবে, সেটা, আমার ধারণা, কেন্দ্র সরকারের কাছে মোটেই অজানা ছিলনা। বরং যারা এই আন্দোলনকে ক্যাবের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ বলে দাবী করছেন বা প্রচার করছেন, আমি তাঁদের সামাজিক প্রেক্ষাপট বিচারের ক্ষমতা এবং রাজনৈতিক ধ্যানধারণা নিয়ে সন্দিগ্ধ।

আমি মনে করি যে এই মুসলমানদের এই বিক্ষোভ মোটেই নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে নয়, সেটা একটা উপলক্ষ মাত্র। তাদের এই বিক্ষোভের মূল কারণ হল তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও সিদ্ধান্তের ভরকেন্দ্র থেকে তাদের ক্রমাগত দূরে সড়ে যাওয়ার বাস্তবিকতা। মোদী সরকার দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পরে, যেভাবে তিন তালাক, ৩৭০ ধারা, ক্যাব নিয়ে একের পর এক দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার ফলে মুসলমানরা উপলব্ধি করতে পারছেন যে ভারতের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার তাদের নির্ণায়ক ক্ষমতা আস্তে আস্তে হ্রাস পাচ্ছে। আর গতকালের বিক্ষোভ, আমার মতে, সেই হতাশারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

ভারতে বসবাসকারী মুসলমানরা খুব ভাল করে জানেন যে ক্যাবের কোন প্রভাব তাদের উপর পড়বেনা কিন্তু তার সাথে তারা এটাও জানেন যে তাদের কৌমের যারা সীমান্ত পেড়িয়ে এসে, রাজনৈতিক দলগুলোর বদান্যতায়, শুধু একটা ভোটের বদলে, খুব সহজেই এদেশের নাগরিকত্ব সহ সমস্ত প্রকার সরকারি সুযোগসুবিধা ভোগ করার অধিকার পেয়ে যেত, সেটা আর সম্ভব হবেনা। মুসলমানদের নিজের কৌমের প্রতি দরদ ও ফরজ হিন্দুদের থেকে অনেক বেশী আর তাই তারা নিজেদের সাথে, তাদের কৌমের অসুবিধার বিরুদ্ধেও সোচ্চার হতে পারে।

যদিও স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন যে "আমার কথা বিশ্বাস কর, তখন—কেবল তখনই তুমি প্রকৃত হিন্দুপদবাচ্য, যখন ঐ নামটিতেই তোমার ভিতরে মহাবৈদ্যুতিক শক্তি সঞ্চারিত হইবে; তখন—কেবল তখনই তুমি প্রকৃত হিন্দুপদবাচ্য হইবে, যখন যে-কোন দেশীয়, যে-কোন ভাষাভাষী হিন্দুনামধারী হইলেই অমনি তোমার পরমাত্মীয় বোধ হইবে; তখন—কেবল তখনই তুমি হিন্দুপদবাচ্য, যখন হিন্দুনামধারী যেকোন ব্যক্তির দুঃখকষ্ট তোমার হৃদয় স্পর্শ করিবে আর তুমি নিজ সস্তান বিপদে পড়িলে যেরূপ উদ্বিগ্ন হও, তাহার কষ্টেও সেইরূপ উদ্বিগ্ন হইবে; তখন— কেবল তখনই তুমি হিন্দুপদবাচ্য, যখন তুমি তাহাদের নিকট হইতে সর্বপ্রকার অত্যাচার ও নির্যাতন সহ্য করিতে, প্রস্তুত হইবে।"(স্বামীজির বাণী ও রচনা, পঞ্চম খন্ড)। বহু হিন্দুই স্বামীজিকে শ্রদ্ধা করলেও, তাঁর এই কথার মর্মার্থ উপলব্ধি করতে অক্ষম। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা তো বটেই, এমনকি অনেকক্ষেত্রে তথাকথিত হিন্দুত্ববাদীরাও নিজেদের ব্যক্তি ও সাংগঠনিক স্বার্থের উপরে উঠে, হিন্দু সমাজের সামগ্রিক লাভের কথা বিবেচনা করতে পারেননা আর তাই যে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন হিন্দু শরণার্থীদের জন্যে আশীর্বাদ স্বরূপ, তারা সেটারই বিরুদ্ধে, মুসলমানদের মত, সোচ্চার হয়।

যাই হোক, যেটা বলছিলাম যে গতকাল দ্বিপ্রহরের নামাজের পর শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ, যা আজও অনেক যায়গায় চলছে, সেটা শুধু পূর্বপরিকল্পিত নয়, প্রত্যাশিতও বটে। নীচের লিঙ্কে ক্লিক করে, বিবিসি-র ভিডিওটা দেখলে বুঝতে পারবেন যে দেশের পরিস্থিতি কিভাবে বদলাচ্ছে। অনুপ্রবেশকারীরা কিভাবে আতঙ্কিত হয়ে ভারত ছাড়ছে। না, এতে আত্মতুষ্টির কোন যায়গা নেই কারণ প্রক্রিয়া সবে শুরু হয়েছে মাত্র তবে পরিস্থিতি যে বদলাচ্ছে এটা স্পষ্ট। আর সেই ভিডিওতেই দেখতে পাবেন যে সবচেয়ে বেশী অনুপ্রবেশকারী দেশ ছাড়ছে পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার সীমান্ত দিয়ে। হ্যাঁ, মমতা ব্যানার্জী ক্যাব ও NRC নিয়ে যতই সোচ্চার হন, অনুপ্রবেশকারীরা আর তাঁর দেয়া আশ্বাসে সন্তুষ্ট হতে পারছেনা, ভরসা রাখতে পারছেনা কারণ তারা দেখছে যে সিপিএম শাসনে মহারাষ্ট্র থেকে পাঠানো অনুপ্রবেশকারীদের, শাসকদলের এক নেতা উলুবেড়িয়া স্টেশন থেকে পুলিসের হাত থেকে ছিনিয়ে নিলেও, মমতার আমলে কর্ণাটক থেকে পাঠানো অনুপ্রবেশকারীদের মালদা সীমান্ত দিয়ে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।

তাই বলছি, জলের উপরের ঢেউ দেখে, গভীরতা মাপার চেষ্টা করবেন না। এই পুরো প্রক্রিয়া রূপায়িত হচ্ছে অনেক পরিকল্পনা অনুসারে। যেভাবে প্রেসার কুকারে যাতে বিস্ফোরণ না ঘটে তাই সেফটি ভালব থাকে যেটা অতিরিক্ত বাষ্প  চাপকে মাঝে মাঝে বের করে দেয়, এখানেও সেই একইভাবে চাপ বের করে দেয়ার প্রক্রিয়া চলবে যার অন্তিম লক্ষ্য হল খাবারকে সুসিদ্ধ করা।

https://youtu.be/jgkATwsClHk

No comments:

Post a Comment