Sunday, October 5, 2014

মৃত্যু

মৃত্যু কি, দুঃখ; কষ্ট; যন্ত্রনা, বিরহ? মৃত্যু মানে হয়তো এই সবকটিই কিন্তু সেটা যারা বেঁচে থাকছে তাদের জন্যে। কিন্তু যে মারা যাচ্ছে তাঁর দৃষ্টি দিয়ে দেখলে মৃত্যু কি শুধু বেদনাতেই আবদ্ধ? জীবনটাকে যদি একটা সুন্দর স্বপ্ন বলে ভাবি, তাহলে মৃত্যু কি তার থেকে জাগরণ নয়? এই মহাবিশ্বের মহাকালের প্রেক্ষিতে আমাদের জীবনকালের সত্তর-আশিটা বছর কতটাই বা মূল্য রাখে?

জীবন মানে যদি চেতনা হয়, তাহলে এই জগতের কতটুকু আমাদের চেতনার অধীন?আমাদের চেতনা তো আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়ের অনুভূতির মুখাপেক্ষী। বিশ্বচরাচর কি এই ক্ষুদ্র পরিসরে পরিমাপযোগ্য? পঞ্চভূতের বিভিন্ন অনুপাতে সৃষ্ট আমাদের এই নশ্বর দেহ যে প্রকৃতির অংশবিশেষ, তার বিশালত্বের কতটা আমরা জীবিত বা চেতন অবস্থায় অনুভব করতে পারি? আমাদের চেতনার পরিসরের বাইরেও যে এক বিরাট অতিচেতন জগৎ বিরাজ করছে; জীবিত অবস্থায় আমরা ক’জন সেটা অনুভব করি?

মৃত্যু মানে কি সেই চেতন জগৎ-র গণ্ডি পেরিয়ে অতিচেতনের উদ্দেশ্যে যাত্রা নয়? জীবিতাবস্থায় লৌকিক নিয়মের নাগপাশে আবদ্ধ আমাদের বোধশক্তিকে মৃত্যু কি মুক্ত করে দেয়না? “তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই-- কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই” – কাকে উদ্দেশ্য করে কবিগুরু এই রচনা করেছেন? কোন শক্তির কাছে কবিগুরু নিজের প্রাণমন অর্পণ করেছেন? আমরা চেতনকালে ষড়রিপুর বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যে শক্তি ও তাঁর বিশালত্বকে উপলব্ধি করতে পারিনা, কবিগুরু তাঁর আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে সেই বিশালত্বেকে অনুধাবন করে সেই শক্তিরই বন্দনা করেছেন। 
 
চেতনার জগৎকে অতিক্রম করে অতিচেতনার জগৎকে অনুভব করার সুযোগ মৃত্যু সকলকেই দেয় – কাউকে আগে তো কাউকে পরে। আর যারা জীবিতকালেই সেই অতিচেতনার জগৎকে অনুভব করতে পারে তাঁরাই আদি শঙ্করাচার্যের মত উদাত্ত কন্ঠে বলতে পারে –  
“ন মে মৃত্যু শঙ্কা ন মে জাতিভেদা, (আমার মৃত্যুভয় নেই, জাতিভেদ নেই) 
পিতা নৈব মে নৈব মাতা নাঃ জন্মা, (পিতা নেই, মাতা নেই, আমার কখনো জন্মই হয়নি) 
না বন্ধুর না মিত্রম গুরুর নৈব শিষ্যা, (আত্মীয় নেই, বন্ধু নেই, গুরু বা শিষ্য নেই) 
চিদানন্দরুপ শিবহম শিবহম। (আমি হলাম পরম সত্বা, আমিই হলাম শাশ্বত শিব) 
 
অহং নির্বিকল্প নিরাকার রুপ, (আমার ভিন্ন সত্বা নেই, কোন আকার নেই)
বিভুত বাচ্য সর্বত্র সর্বেন্দ্রিয়ানাম, (আমি সর্বত্র বিরাজ করি, সকল অনুভূতি আমাতেই) 
ন চ সংগঠন নৈব মুক্তির না মেয়া (আমি যুক্ত নই, মুক্ত নই, বদ্ধ নই) 

চিদানন্দরুপ শিবহম শিবহম। (আমি হলাম পরম সত্বা, আমিই হলাম শাশ্বত শিব)

মুক্তিপথ

১২ হাত কাপড়েও নাকি বাঙালী মেয়েদের কাছা হয়না - প্রবাদটার উৎস কখন বা কিভাবে হল সেটা আমার জানা নেই তবে এই আপাত নিরীহ কথাটির মূল লক্ষ্য যে বাঙালী মেয়েদের সাহস ও সক্ষমতার প্রতি বক্রোক্তি সেটা সহজেই অনুমেয়। পরিবেশগত কারণ হোক বা স্বভাবগত কারণ, একথা ঠিক যে বাঙালী মেয়েরা ভারতের অন্য প্রদেশের মেয়েদের তুলনায় অনেক নমনীয়। কিন্তু এই নমনীয়তা কেবলমাত্র শারীরিক। মানসিক দিক থেকে তারা অন্যান্যদের তুলনায় কিছুমাত্র কম সক্ষম নয়, বরং বহুক্ষেত্রে অনেক বেশী পারদর্শী। মণ্ডন মিশ্রের ধর্মপত্নী হন বা দ্রবময়ী, হটি বিদ্যালঙ্কার হন বা দেবী চৌধুরানী - এঁরা সকলেই এই বঙ্গের সন্তান এবং আপন কীর্তিতে দীপ্যমান। প্রথমোক্ত তিনজন বিদ্যাচর্চার মাধ্যমে নিজ জন্মভূমির গৌরব বৃদ্ধি করেছিলেন। আর শেষোক্তজন অস্ত্রচর্চার মাধ্যমে জন্মভূমির মানরক্ষা করেছিলেন।

সারা দেশের মত এই বাংলাতেও মুসলিম আক্রমণের পর থেকেই মেয়েদেরকে পর্দানশীন জীবন বেছে নিতে বাধ্য করা হয়। যেসব পাঠশালা ছোট ছোট মেয়েদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে থাকত, সেখানে শ্মশানের নীরবতা নেমে আসে। পুতুল নিয়ে খেলা করার বয়সে তাদেরকে ঘোমটা পরে ছাদনাতলায় বসতে হয়। এর ফলে সমাজের অর্ধেক অংশের কাছে শিক্ষা ক্রমে ক্রমে একটি নিষিদ্ধ বস্তুতে রূপান্তরিত হয়।  ইসলামিক ব্যবস্থায় নারীদের ভূমিকা শুধুমাত্র পুরুষের যৌনলালসা তৃপ্তি ও বংশবৃদ্ধির যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। মুসলিম শাসনে সেই মানসিকতা ক্রমে ক্রমে সমাজের বাকি অংশকেও গ্রাস করে। তাই নারীশিক্ষা শব্দটি ধীরে ধীরে সমাজ থেকে বিলীন হতে থাকে।

ইতিহাসের শিক্ষা থেকে এটা স্পষ্ট যে ইসলামিক আগ্রাসনের দুটি মুখ্য অংশ - অস্ত্র এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি। যখন তারা সংখ্যালঘু থাকে তখন অনিয়ন্ত্রিত হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে। আর এইভাবে যখন সংখ্যাগুরু হয়ে যায় তখন অস্ত্র দ্বারা বিরোধীদের ধবংস করে। পৃথিবীর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে যে যখনই কোন স্থান মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েছে, তখনই তারা সেই স্থানের মূলধারা থেকে আলাদা হয়ে গেছে।

এই ফর্মূলা অনুসারেই ১৯৪৭-এ পাকিস্তান তৈরী হয়েছিল। আর পশ্চিমবঙ্গকে ভারতবর্ষ থেকে আলাদা করে একটি ইসলামিস্তান বানানোর যে পরিকল্পনা বামফ্রন্ট শাসনে শুরু হয়েছিল, “পরিবর্তনের” পর তৃণমূল শাসনে তা নতুন গতি লাভ করেছে। ‘মা, মাটি আর মানুষের’ দোহাই দিয়ে তৈরী সরকার যে ‘মুসলিম, মৌলবি,মাদ্রাসা আর মসজিদে’র সরকারে পরিণত হবে -  এমনটা হয়ত ভোটারদের দুঃস্বপ্নতেও ছিলনা। ৩৪ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামে যেসব দরিদ্র হিন্দুরা প্রশাসনিক মদতে ইসলামিক অত্যাচারে জর্জরিত হয়েছিল, তারা ভেবেছিল “পরিবর্তনের” পর দিন বদলাবে। কিন্তু হায়, তারা বোঝেনি যে শাসকের পরিবর্তন মানেই শাসনের পরিবর্তন নয়। আগে তারা লাল জামা পরা ইসলামি অতাচারের শিকার হত, এখন সবুজ জামা পরা ইসলামি অতাচারের শিকার হচ্ছে - এটাই পরিবর্তন।

কামদুনির ঘটনা কি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়না যে হিন্দু মেয়েদের উপর মুসলিম বর্বরতার বিরুদ্ধে উপযুক্ত আইনি ব্যবস্থা নিতে সরকার কত উদাসীন? সংগ্রামপুরে বিষমদ খেয়ে ১৭৩ জন মারা যাওয়ার জন্যে জন্যে দায়ী খোঁড়া বাদশার বেকসুর খালাস পাওয়া কি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা? সন্দেশখালিতে প্রশাসনকে নজরানা দিয়ে শাহজাহান শেখ, যে আগে সিপিএমের পতাকা বইত আর আজ তৃণমূলের হয়ে পঞ্চায়েতের উপপ্রধান, দিনের পর দিন তপশীলিদের পৈতৃক জমি সম্পূর্ণ  বেআইনিভাবে দখল করে রেখেছে এটাই কি পরিবর্তন? আব্দুল বারিক বিশ্বাসের মত কুখ্যাত স্মাগলার পার্টি ও প্রশাসনের বদান্যতায় বিনা বাধায় চোরাচালান চক্র চালিয়ে যেতে পারে, এই কি পরিবর্তন?

আজও কি আপনি নিশ্চিত যে এই ইসলামি সন্ত্রাসের সামনে আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিরাপদ? আপনি কি মনে করেন যে সেকুলারিজমের চাদর চোখে বেঁধে আপনি এই বিপদকে এড়িয়ে যেতে পারবেন? আপনি কি পারবেন আপনার বাড়ির মেয়েদের পদ্মিনীর মত জহরব্রত নিয়ে আগুনের মধ্যে ঠেলে দিতে? নাকি আপনার আদর্শ হবে সত্যবতী?

সত্যবতী - সঙ্গম রায় কাপুরের উত্তরপুরুষ বর্ধমান রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা কৃষ্ণ রায়ের ছোট মেয়ে। ষোড়শী রাজকন্যা, অপূর্ব সুন্দরী। সাল ১৭৯৬, শোভা সিং এবং রহিম খাঁ যৌথ ভাবে বর্ধমান রাজ্য আক্রমণ করে। রাজা কৃষ্ণ রায় পুত্র অম্বর রায়কে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যান এবং যাওয়ার আগে রানীকে বলে যান যে তাঁদের  পরাজয়ের খবর পেলে, বিধর্মীর কাছে ইজ্জত দেবার বদলে পরিবারের মেয়েরা যেন আত্মহত্যা করে। কয়েকদিন পরে রাজার পরাজয়ের খবর এলে রানীমা সবাইকে ডেকে তাদের হাতে কালকূট তুলে দেন। পরিবারের বাকি মেয়েরা সেই বিষ হাসি মুখে গ্রহণ করলেও, সত্যবতী তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। ফলে, আক্রমণকারীরা প্রাসাদে প্রবেশ করে সবাইকে মৃত দেখলেও সত্যবতীকে জীবিত অবস্থায় পায়। সত্যবতীর রূপে মুগ্ধ হয়ে শোভা সিং রহিম খাঁকে প্রাসাদের সমস্ত সম্পদ নিয়ে বিনিময়ে তাকে সত্যবতীকে দিয়ে দিতে বলে। সত্যবতী বন্দিনী হল স্বেচ্ছায়, বিনা প্রতিবাদে। রাত্রিবেলায় প্রহরীর দল তাকে পৌঁছে দিল শোভা সিং-র ঘরে। তার পাশবসত্বা তখন পুরোমাত্রায় জেগে উঠেছে। সে একটানে খুলে দিল সত্যবতীর ওড়না। ছিঁড়ে ফেলল তার ঘাগরা। ভিতরে অধোবাস। দেহের সঙ্গে লেপটে থাকা চুড়িদার-চুস্ত। কামাতুর শোভা সিং সত্যবতীর চুড়িদারের ফাঁস খোলার চেষ্টা করে। কিন্তু কি বজ্রআঁটুনি, কিছুতেই খুলতে পারেনা। এবার সে দুহাতে ফাঁস খোলার চেষ্টা করে। আর এই মুহূর্তটির জন্যেই এতক্ষণ এত নিগ্রহ সহ্য করেছে সত্যবতী। সে সন্তর্পণে নিজের ডান হাত বুকের ভিতর ঢুকিয়ে দেয়। পরমুহূর্তেই একটি প্রচন্ড আর্তনাদে দরজার বাইরের প্রহরীরা চমকে ওঠে। আর্তনাদ প্রত্যাশিতই ছিল, তবে সেটা রমণ শীৎকার। কিন্তু এ যে পুরুষের আর্তনাদঃ দরজা ভেঙে তারা যখন ভিতরে প্রবেশ করল তখন সত্যবতীর দেহে প্রাণ নেই। আর বর্ধমান রাজপ্রাসাদজয়ী শোভা সিং পড়ে আছে মাটিতে। তার গলায় বিঁধানো আছে একটি একটি ছোট্ট কিন্তু মারাত্মক ছুরিকা।

মহাভারতের শিক্ষা

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ চলাকালীন পাণ্ডবরা যে কয়টি সিদ্ধান্ত সমকালীন যুদ্ধনীতির বিরুদ্ধে নিয়েছে, সেটি শিখণ্ডীকে সামনে রেখে ভীষ্মকে পরাস্ত করাই হোক বা দ্রোনাচার্যর কাছে যুধিষ্ঠিরকে দিয়ে তাঁর ছেলে অশ্বথামার মিথ্যা মৃত্যুসংবাদ পাঠিয়ে তাঁকে অস্ত্রত্যাগ করতে বাধ্য করাই হোক, সেটি নিরস্ত্র অবস্থায় কর্ণকে বধ করতে অর্জুনকে প্ররোচিত করাই হোক বা গদাযুদ্ধের সময় দুর্যোধনের ঊরুতে আঘাত করার জন্যে ভীমকে ইঙ্গিত করাই হোক, সেই সবকটি সিদ্ধান্তর পিছনেই শ্রীকৃষ্ণর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ; যাকে যুগাবতার বলে মানা হয়, যিনি যুদ্ধ যাতে না হয় তার জন্যে আপ্রান চেস্টা করেছিলেন, তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে এরকম অনৈতিক সিদ্ধান্তগুলি কেন নিলেন?

এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে প্রতিটি ঘটনাকে বিক্ষিপ্তভাবে না দেখে, সম্পূর্ন্য যুদ্ধের প্রেক্ষিতে বিচার করতে হবে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ছিল ধর্ম আর অধর্মের মধ্যে। ন্যায় আর অন্যায়ের মধ্যে। সে যুদ্ধে পান্ডব এবং তাঁদের পক্ষে যারা লড়াই করেছিল তারা ছিল ধর্মের অনুসারী অপরদিকে কৌরববাহিনী  ছিল অধর্মের প্রতীক। তাই ধর্মের শাষন প্রতিষ্ঠা করার জন্যে কৌরবশাসনের পরাজয় ছিল একান্ত প্রয়োজনীয়। আর ভীষ্ম, দ্রোনাচার্য, কর্ণ বা দুর্যোধনের মত মহারথীরা বেঁচে থাকলে সেই অভীষ্ট লক্ষ্য অধরাই থেকে যেত। তাই তাঁদের মৃত্যু ছিল লক্ষ্যপূরণের পূর্বশর্ত। ইংরেজীতে একটা কথা আছে – End justifies the means। শ্রীকৃষ্ণ এই আপ্তবাক্যটিরই ব্যবহারিক রুপ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন।


আজকের দিনে আমরা যারা শ্রীকৃষ্ণকে ভগবানরূপে পূজো করি তাদের মধ্যে কতজন শ্রীকৃষ্ণর এই ব্যবহারিক জ্ঞ্যান নিজেদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করি? কেন আমরা আজকের শাসকশ্রেণীর কর্মকে অবজ্ঞ্যা করে শুধু তাদের নামের কৌলিণ্যে মগ্ন রয়েছি? কারুর ব্যক্তিত্ব বা পূর্বকর্মই যদি তাঁকে বিচার করার একমাত্র মাপকাঠি হত তাহলে শ্রীকৃষ্ণ কেন পাণ্ডবদের যুদ্ধের নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে ভীষ্ম, দ্রোনাচার্য, কর্ণ বা দুর্যোধনের মত মহারথীদের বধ করতে প্ররোচিত করলেন? এটাই ভারতের দুর্ভাগ্য যে ভারতবাসীরা শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান বলে পূজো করেছে, তাঁর নামে মন্দির বানিয়েছে কিন্তু নিজেদের জীবনকে শ্রীকৃষ্ণর মত ব্যবহারিক জ্ঞ্যান দ্বারা চালিত করেনি। আর তারই পরিণতিতে আজও তাঁরা অধর্মের শাসনের অধীন হয়ে নিজেদের নিয়তিকে দোষারোপ করে চলেছে। বেদব্যাস বর্ণিত (রচিত নয়) মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ বারংবার কর্মের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন, ধর্মকে গতিশীল ও রাষ্ট্রমূখী করার আহ্বান জানিয়েছেন কিন্তু হায়, তাঁকে ঈশ্বররূপে কল্পনা  করতে ব্যস্ত আমরা শুধু তাঁর পূজোই করে গেছি, তাঁর আহ্বানে সাড়া দেইনি।

ধর্মযুদ্ধ

মহাভারতের শল্য পর্ব- কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আঠারোতম তথা শেষ দিন। দুর্যোধন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে সরোবরের নিচে লুকিয়ে আছে। তাকে খুঁজতে খুঁজতে শ্রীকৃষ্ণ ও ধৃষ্টদুম্ন্য সহ পঞ্চপাণ্ডব সেখানে উপস্থিত হয় এবং ভীম দুর্যোধন কে গদাযুদ্ধের আহবান জানায়। এমন সময়  শ্রীকৃষ্ণ-র দাদা বলরাম তাঁর তীর্থযাত্রা সেরে সেখানে এসে পৌঁছান।  ঘটনাচক্রে ভীম এবং দুর্যোধন দুজনই তাঁর গদাযুদ্ধের শিষ্য ছিল সুতরাং তাঁকে যুদ্ধের বিচারক হিসেবে মেনে নিতে কেউই আপত্তি করলনা।

অতঃপর গদাযুদ্ধ শুরু হল। বেশ কিছুক্ষণ সমানে সমানে লড়াই চলার পর যুদ্ধের গতি ধীরে ধীরে দুর্যোধনের  পক্ষে যেতে লাগল। ভীম ক্রমেই নিয়ন্ত্রণ হারাতে লাগল। এমন সময় শ্রীকৃষ্ণ ভীমকে হস্তিনাপুর রাজসভায় করা  তার প্রতিজ্ঞা মনে করিয়ে দিতে নিজের জঙ্ঘার দিকে ইঙ্গিত করলেন। এরপর, ভীম গদাযুদ্ধের নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে সজোরে দুর্যোধনের জঙ্ঘাতে আঘাত করে এবং তাকে ধরাশায়ী করে ফেলে।  

গদাযুদ্ধের নিয়ম অনুসারে লড়াইয়ের সময় কাউকে কোমরের নিচে আঘাত করা যায়না কিন্তু সেই নিয়মের পালন না করে ভীমের এই প্রহারে বলরাম অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন এবং ভীমকে আক্রমণ করতে আসেন। তখন শ্রীকৃষ্ণ এগিয়ে এসে বলরামকে প্রতিহত করেন এবং তাঁর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করেন। শ্রীকৃষ্ণ বলেন- আজ ভীমের আক্রমণের ঔচিত্য নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করা বলরাম তখন কেন নীরব ছিলেন যখন হস্তিনাপুর রাজসভায় কূলবধূ দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করা হয়েছিল? তখন কেন নীরব ছিলেন যখন জতুগৃহে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা করা হয়েছিল? তখন কেন নীরব ছিলেন যখন অভিমন্যুকে সপ্তরথী মিলে একসাথে অন্যায় যুদ্ধে হত্যা করেছিল? একপক্ষ বিনা প্রতিবাদে একের পর এক অন্যায় করেই যাবে আর তাদের বিরুদ্ধে অপরপক্ষ ক্রমাগত নীতি মেনে লড়াই চালাবে এটা কী ধরনের ন্যায়? এরপর শ্রীকৃষ্ণ বলরামকে ভৎর্সনা করে বলেন যে, কুরুক্ষেত্রের ধর্মযুদ্ধ শুরু হবার আগে যুধিষ্ঠির ও দুর্যোধন দুজনই তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল নিজ নিজ পক্ষে যোগদান করার জন্য। কিন্তু তিনি সেই সময় কোন পক্ষেই যোগ না দিয়ে তীর্থভ্রমণে বেরিয়ে যান। দেশে যখন ধর্ম আর অধর্মের মধ্যে লড়াই হচ্ছে তখন সেই যুদ্ধে কেউ নিরপেক্ষ থাকতে পারেনা, হয় সে ধর্মের পক্ষে অথবা অধর্মের। তখন যুদ্ধক্ষেত্রই একমাত্র তীর্থক্ষেত্র।  


আজ পশ্চিমবঙ্গে আবার কি সেই ধর্ম আর অধর্মের মধ্যে লড়াই-র পথে এগিয়ে চলছেনা? জেহাদি সন্ত্রাস একের পর এক অন্যায় করেই চলেছে আর আমরা চোখে ধর্মনিরপেক্ষতার ঠুলি এঁটে শান্তির হাঁপু বাজিয়ে চলেছি। কামদুনি, মধ্যমগ্রাম সহ সারা রাজ্যে কত শত বোনের সম্মান দ্রৌপদীর মত লুণ্ঠিত হচ্ছে। বনগাঁর দীপঙ্করের মত কত শত যুবক অভিমন্যুর মত জেহাদি সপ্তরথীদের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। ক্যানিং, পাঁচলা  সহ পশ্চিমবঙ্গের কত গ্রাম জিহাদি আগুনে বারনাবরতের জতুগৃহের মত পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে আর আমরা পুণ্য করতে গঙ্গাসাগরে গিয়ে ডুব দিচ্ছি বা মন্দিরে মন্দিরে পূজা দিচ্ছি যাতে “ঠাকুর রক্ষা করেন”। কিন্তু ইতিহাস বলছে যে ঠাকুর আমাদের ১৯৪৭এ রক্ষা করেননি। জেহাদি সন্ত্রাসের সামনে নিজেদের বাপ-ঠাকুর্দার ভিটে ছেড়ে, মা-বোনেদের ইজ্জত খুইয়ে আমরা উদ্বাস্তুর হয়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম। ধর্মনিরপেক্ষতার মেকি বুলি আমাদের কোন রকম নিরাপত্তা দিতে সেদিনও পারেনি আর আজও পারছেনা। কারন আমরা ভুলে গেছি যে ঠাকুর নিজে বলেছেন যে “যখন ধর্ম আর অধর্মের মধ্যে লড়াই হচ্ছে তখন যুদ্ধক্ষেত্রই একমাত্র তীর্থক্ষেত্র”।