Monday, May 31, 2021

বিজেপির হতাশা

নারদা কান্ডে চার্জশিট পেশের সময় গ্রেপ্তারি হোক বা মুখ্যসচিব পদে এক্সটেনশন দেয়ার পর বদলির আদেশ, এসবই আসলে অমিত শাহর হতাশার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। তিনি এখনও ভাবতেই পারছেননা যে রাজ্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে, চলতি ভাষায়, মুরগী বানিয়ে, নিজেদের পকেট ভারী করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে, বিজেপি নিজেদের যাবতীয় শক্তি ঢেলে দেয়ার পরেও যে ফল হয়েছে তা নিঃসন্দেহে বিপর্যয়। 

আসলে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির অবস্থা অনেকটা বলিউডে ক্যাটরিনা কাইফের মত হয়েছে। দীর্ঘদিন বলিউডে কাজ করার পরেও, ক্যাটরিনার হিন্দি উচ্চারণ এতটাই যান্ত্রিক যে এখনও তিনি খাঁটি ভারতীয়র ভূমিকায় খাপ খাওয়াতে পারেননা। তাকে যদি কোন সিনেমায় 'গাঁও কি গোরী' হিসাবে দেখানো হয় তাহলে সেই সিনেমার পরিণতি কি হবে সেটা সহজেই অনুমেয়। এই কারণে চিত্রনাট্য তৈরীই করা হয় তাকে প্রবাসী ভারতীয় হিসাবে দেখাতে। প্রায় একইরকম সমস্যা ছিল বাংলা সিনেমাতে অরুন্ধতী দেবীর। তার অ্যাপেয়ারেন্সটা এতটাই বনেদী ছিল যে তাকে গ্রামের কোন সরল, সাধাসিধা মেয়ের ভূমিকায় মানাতনা। এই নিয়ে তিনি নিজেও ক্ষেদ প্রকাশ করেছেন কিন্তু পরিচালকের কিছু করার ছিলনা।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির অবস্থাও হয়েছে সেই ক্যাটরিনা কাইফের মত। যাই করুক না কেন, 'জয় শ্রী রাম' না বললে ঠিক কমফোর্ট জোনে যেতে পারেনা। এমনকি কফি হাউসের দখল নিতেও গেছিল গেরুয়া গেঞ্জি পরে। না, কফি হাউস বাংলার সংস্কৃতির একমাত্র প্রতীক নয় কিন্তু যারা সেটার দখল নিতে যাচ্ছে, তারা তো সেটা ভেবেই যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে, যস্মিন দেশে, যদাচার করতে বাধা কোথায়? বাধা সেই ক্যাটরিনা কাইফ। তাকে NRI দেখালে তবে কনফিডেন্স আর কমফোর্ট পায় আর বঙ্গ বিজেপির কনফিডেন্স আর কমফোর্ট হলো গেরুয়া শার্ট আর জয় শ্রী রাম। 

এরইফলে, মমতা ব্যানার্জী ক্রমাগত বিজেপিকে বহিরাগত বলে আক্রমণ করেছেন আর বিজেপিও নিজেদের চেনা ফর্মুলার বাইরে না বেরিয়ে, সেই অভিযোগকেই যথার্থ প্রমাণ করেছে। পশ্চিমবঙ্গে লাভ জেহাদ যে একটা বড় বিপদ সেটা নিয়ে তপন ঘোষ প্রথম যখন সোচ্চার হয়েছিল তখন সেটার মধ্যে মাটির গন্ধ ছিল। কেউ সেটাকে বাঙালী পরিচয়ের প্রতি থ্রেট বলে ভাবেনি। কিন্তু বিজেপি নেতারা যখন তাদের ভাষণে 'অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াড' তৈরীর প্রতিশ্রুতি দেন, বাঙালী তখন সেটার সাথে একাত্ম হতে পারেনা। বরং আতঙ্কিত হয় যে এই রাজ্যকেও বোধহয় বদলানোর ষড়যন্ত্র হচ্ছে।

বঙ্গবিজেপি যতদিন না পর্যন্ত এই ক্যাটরিনা কাইফ সিনড্রোম থেকে বেরোতে পারবে, তাদের পক্ষে সাফল্য পাওয়া কঠিন। অনেকেই হয়তো এটা শুনে ২০১৯ এর ১৮টা আসনের উদাহরণ দেবেন কিন্তু তারা ভুলে যাবেননা যে সেই নির্বাচন হয়েছিল পুলবামা আর বালাকোটের আবহে, জাতীয়তাবাদের প্রেক্ষাপটে। সেই লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির আঞ্চলিক পরিচয়ের থেকেও জাতীয় পরিচয় নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। তবে সময় কখনও থেমে থাকেনা। রাজনীতিতে সাফল্য আর ব্যর্থতা - দুই-ই ক্ষণস্থায়ী। ভুল থেকে যে দল তাড়াতাড়ি শিক্ষা নিতে পারবে, তারই লাভ।

Thursday, May 27, 2021

ডিজিটাল দ্বারপাল

ডিজিটাল পৃথিবীতে কোন কিছুই আর গোপন নয়। আপনার করা প্রতিটি বার্তালাপ (conversation), প্রতিটি বিনিময় (transaction) এর ছাপ থেকে যায় সারা জীবনের জন্যে। আপনি হয়তো Incognito অথবা VPN ব্যবহার করে নিজেকে নিরাপদ ভাবছেন কিন্তু ভুলে যাচ্ছেন যে ব্রাউজার এবং আপনার ব্যবহৃত কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনের ব্রাউজিং ইতিহাসে সেই তথ্যের প্রতিলিপি থেকেই যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আপনার বিনিময় করা তথ্যের নিরাপত্তার জন্যে আপনি বিশ্বাস করছেন গুগল, ফেসবুক, ট্যুইটার বা হোয়াটসঅ্যাপের মত কারিগরি দৈত্যদের (technical giants) দেয়া আশ্বাসবাণীর উপরে যে আপনার তথ্য পুরোপুরি encrypted। এবার এই encryption কতটা সত্যি আর কতটা নিরাপদ সেটা নিয়ে আপনি তো ছাড়, কোন সরকারেরও পুরোপুরি ধারণা নেই। এই কারিগরি দৈত্যদের মুখ্যালয়ে, যেখানে বিভিন্ন সার্ভারের মাধ্যমে বিনিময় বা সঞ্চিত হচ্ছে আপনার তথ্য, সেখানে প্রবেশাধিকার রয়েছে কেবলমাত্র বিশেষাধিকার প্রাপ্ত কিছু ব্যক্তির। ফলে, তাদের দেয়া আশ্বাসবাণীর কতটা ঠিক, সেটা বিচার করার ক্ষমতা নেই আমার বা আপনার।

এই পরিস্থিতিতে, ভারত সরকার বর্তমান IT আইনে কিছু পরিবর্তন করে, সোশ্যাল মিডিয়াকে, তাদের মাধ্যমে প্রচারিত তথ্যের বিষয়ে দায়িত্বশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। এটা অস্বীকার করার কোন যায়গা নেই যে আজ থেকে ১৫ বছর আগে চলা অর্কুট বা ইয়াহু মেসেঞ্জার ছিল মূলত ব্যক্তিগত আলাপচারিতার মাধ্যম। এমনকি প্রাথমিক অবস্থায় ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপের ব্যবহারও ছিল প্রধানত ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু বর্তমানে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারের এবং তার মাধ্যমে স্বার্থসিদ্ধির অন্যতম হাতিয়ার। দেশের বিভিন্ন যায়গায় গণপিটুনির ফলে যেসব মৃত্যু ঘটেছে সেগুলি ঘটানোর পিছনে ব্যবহৃত হয়েছে হোয়াটসঅ্যাপের মত অ্যাপ। তাই, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আইনের পরিবর্তনটাও জরুরী আর সেটা মাথায় রেখেই, পরিবর্তিত আইনে, সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রচারিত কোন বার্তার, যা দেশের একতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হতে পারে, দায় নিতে হবে সেই মিডিয়াকেও। প্রয়োজনে প্রশাসনকে জানাতে হবে যে সেই বার্তার উৎস কোথা থেকে হয়েছে। আর সেই কাজ করার জন্যেই কোম্পানিগুলোকে বলা হয়েছে একজন কমপ্লায়েন্স অফিসার (যিনি দেখবেন যে আইন ঠিকমত অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা), একজন নোডাল অফিসার (যিনি প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ রাখবেন) এবং একজন অভিযোগ সুরাহার অফিসার বা Grievance Redressal Officer (যার কাছে অভিযোগ জানানো যাবে) আর এদের তিনজনেরই ভারতের কোন ঠিকানা দিতে হবে যাতে অনির্দিষ্টকালের জন্যে উত্তরের অপেক্ষায় বসে না থাকতে হয়। আর একইসাথে, প্রতি মাসে, অভিযোগ প্রাপ্তি ও সেগুলির সুরাহার বিষয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করতে হবে।

এখানেই বড় কোম্পানিগুলোর ব্যথা হচ্ছে যে এতদিন তারা, encryption ও ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তার বাহানায় যে দায়িত্ব এড়িয়ে যেত এবার থেকে সেগুলির দায় তাদের নিতে হবে। গ্রাহকদের বিভিন্ন তথ্য, এমনকি তাদের বিনা অনুমতিতে নেয়া তথ্য বেচেও তারা যে বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করতো অথচ সেগুলির দায় তাদের ছিলনা, এবার সেই পরিস্থিতি বদলাতে যাচ্ছে। আপনার তথ্যের বিনা অনুমতিতে ব্যবহার কিভাবে হয় সেটা খুব সহজে বুঝতে ফ্লিপকার্ট বা অ্যামাজনে যেকোন একটা জিনিস নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করুন আর তারপর ফেসবুক খুলুন, দেখবেন সেই প্রোডাক্টের বিজ্ঞাপন আপনার টাইমলাইনে ভেসে উঠবে। অফ-ফেসবুক অ্যাক্টিভিটির মাধ্যমে ক্রমাগত এই গোয়েন্দাগিরি চালিয়েই যাচ্ছে বিভিন্ন অ্যাপ। এমনকি অ্যালেক্সা বা গুগল ডট-এর মত স্বর চালিত (voice driven) প্রযুক্তির যন্ত্রগুলি, আপনার অনুমতি ছাড়াই রেকর্ড করে নিচ্ছে আপনার পরিবারের আভ্যন্তরীণ আলোচনা।

এমতাবস্থায়, আমি ভারত সরকারের নতুন আইনকে অবশ্যই সমর্থন করি। ডিজিটাল দুনিয়া থেকে আজকে আর বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় কিন্তু সেখানে যখন থাকতেই হবে তখন সেই দুনিয়ার দ্বারপাল হিসাবে, সিলিকন ভ্যালির কোন অজ্ঞাত সার্ভারের বদলে আমি আমার নির্বাচিত সরকার ও প্রশাসনের উপরেই বেশী ভরসা রাখবো।

Saturday, May 22, 2021

পটপরিবর্তন

গণতন্ত্রে প্রত্যেকটা নির্বাচিত সরকারের একটা নির্দিষ্ট সময়কাল আছে আর, আমার বিশ্বাস, কোন সরকারের বিচার তার পূর্ণ সময়কালের ভিত্তিতেই করা উচিত। এই সময়কালের মধ্যে সেই নির্বাচিত সরকার যে কাজ করবে, সেটা আমাদের পছন্দ হোক বা অপছন্দের, সেগুলোকে এক-একটা ফিডব্যাক বা ডাটা হিসাবে মনে রাখা উচিত কিন্তু একটা বা দু'টো কাজের পরিপ্রেক্ষিতে কখনোই সেই সরকার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত নয়।

উদাহরণস্বরূপ, করোনা পরিস্থিতিতে, বিশেষত দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণের সময়, নরেন্দ্র মোদী সরকার এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বা নেয়া থেকে বিরত থেকেছেন যেগুলো অন্যভাবে হলে হয়তো ভাল হতো কিন্তু তার মানে এই নয় যে মাত্র দু'বছর আগে, গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ চাইবো। হ্যাঁ, সমালোচনা হতেই পারে আর সেটাই গণতন্ত্রে কাম্য কিন্তু একইসাথে সহযোগিতার হাতও বাড়িয়ে দিতে হবে। ভজন মন্ডলী তাদের স্তাবকতা বন্ধ করবেনা এটা স্বাভাবিক কিন্তু সুস্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বার্থে, সহযোগিতা ও সমালোচনা একসাথে চলা উচিত।

একইভাবে, রাজ্যের ক্ষেত্রেও এই যুক্তি প্রযোজ্য। সদ্যনির্বাচিত একটা সরকারকে খামোখা উত্যক্ত করার পক্ষপাতী আমি নই। মমতা ব্যানার্জী সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত আমার মনমতো নাই হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে আমার কাছে প্রতিবাদ করার রাস্তাও রয়েছে। যদিও গতবছর মমতা ব্যানার্জী সেই সমালোচনা সহ্য করতে পারেননি এবং আমাকে গ্রেপ্তার করান কিন্তু তা সত্বেও আমার গণতন্ত্র ও সংবিধানের প্রতি পূর্ণ আস্থা আছে আর তাই ভাল কে ভাল আর খারাপ কে খারাপ বলার জন্যে দলের অনুমোদনের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকিনা।

মোদী ঠিক না ভুল এটা আবার নির্ণয় করার সুযোগ আসবে আজ থেকে তিন বছর পরে। এই তিন বছর নিজের মস্তিষ্ক আর বুদ্ধিমত্তাকে উন্মুক্ত রাখুন যাতে এই সময়ের মধ্যে হওয়া যাবতীয় ঘটনা আপনাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। আর হ্যাঁ, তখন যদি আপনার সিদ্ধান্ত হয় যে মোদী ভুল ছিল তাহলে আপনাকেই বাছতে হবে যে মোদীকে সরিয়ে দিলে, তার স্থানে, বিকল্প কে হবে। পশ্চিমবঙ্গে এই বিকল্প মুখ না থাকার কারণেও বিজেপি কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পায়নি, যদিও আমি যখন সেই প্রসঙ্গ তুলেছিলাম তখন ভজন মন্ডলীর অনেকেই আমার কথার প্রতিবাদ করে, আসাম, উত্তর প্রদেশ প্রভৃতি যায়গার উদাহরণ দিয়েছিল। তখনও বলেছিলাম আর এখনও বলছি যে সব রাজ্যের চরিত্র এক নয়। তাই যাকে অপছন্দ, তার বদলে কাকে পছন্দ সেটা এখন থেকেই ভেবে রাখুন।

Thursday, May 20, 2021

প্ল্যান বি

অজয় দেবগণের দৃশ্যম সিনেমাটার কথা মনে আছে? মূল সিনেমাটা শুনেছি যে একটা মালয়ালম সিনেমা থেকে 'অনুপ্রাণিত', তবে মূল সিনেমাটা আমি দেখিনি বলে অজয় দেবগণের সিনেমাটার কথাই বলছি। সিনেমাটাতে অজয় দেবগণ বারবার নিজের পরিবারের নির্দোষ হওয়ার কথা বললেও আর সেটাকে বিভিন্ন সাক্ষী সমর্থন করলেও হঠাৎ একজন সাক্ষী বলেন যে অজয় ও তার পরিবারের সাথে তার সেই ঘটনার দিনের পরেও দেখা হয়েছিল আর তাই তার এতকিছু বিশদে মনে আছে। এটা শুনেই গোয়া পুলিশের ডিআইজির ভূমিকায় অভিনয় করা টাবু বুঝতে পেরে যান যে অজয় কিভাবে পুলিশকে বোকা বানিয়েছে।


হ্যাঁ, ঐ সিনেমার মতই কৈলাশ, মুকুল, দিলীপ বা শিবপ্রকাশরা পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে মোদী-শাহ-নাড্ডাদের একটা সিনেমা দেখিয়েছেন। তারা খুব পরিকল্পিত ভাবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বর সামনে সিনেমার মত দৃশ্য তুলে ধরে দেখিয়েছেন যে বঙ্গ বিজয় শুধু সময়ের অপেক্ষা। আর এই দৃশ্য দেখিয়ে তারা শুধু কেন্দ্রীয় নেতৃত্বর থেকে নয়, বিভিন্ন টিকিট প্রাপক ও ব্যবসায়ীদের থেকেও বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেছেন বলে জানা গেছে। তাদের এই দৃশ্য রচনা দেখে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বর মত স্থানীয় কর্মীরাও আশায় বুক বেঁধেছিল। কিন্তু তারা কেউই বুঝতে পারেনি যে আনারকলি সিনেমার রাজসভায়, পৃথ্বিরাজ কাপুর আকবর সাজতে পারেন কিন্তু তার ফলে তিনি বাস্তবে আকবর হয়ে যাবেন না। 

বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও রাজ্যের কর্মীরা স্বপ্নের জগৎ থেকে বাস্তবের রুক্ষ জমিতে মুখ থুবড়ে পড়েন নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরে। বঙ্গ বিজয় নিশ্চিত ভেবে বিজেপি তার যাবতীয় শক্তি পশ্চিমবঙ্গে উজাড় করে দিয়েছিল। নরেন্দ্র মোদীর প্রায় দুই ডজন সভা হোক বা অর্ণবকে দিয়ে রিপাবলিকের বাঙলা চ্যানেল খোলানো- কার্পণ্য করা হয়নি এতটুকু। অথচ তারপরেও যখন দেখা যায় ২০০ আসনে জয়লাভের দাবী করা বিজেপি বাস্তবে ১০০ টা আসনেও জিততে পারেনি তখন মুখরক্ষা করার জন্যে বিজেপিকে কিছু একটা করতেই হতো নাহলে ক্যাডারদের সামলানো যেতনা।

এই ড্যামেজ কন্ট্রোলের প্রথম ধাপ হিসাবে প্রচার করা হলো যে বিজেপি নাকি একশ'র বেশী আসনে ১০০০ এর কম ভোটে হেরেছে। যদিও বাস্তব হলো যে ১০০০ এর কম ভোটে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়েছে মাত্র ৭টা আসনে আর তারমধ্যে বিজেপি জিতেছে - দিনহাটা, ঘাটাল, বলরামপুর ও কুলটি - ৪টি আসনে আর হেরেছে - জলপাইগুড়ি, তমলুক ও দাঁতন - ৩টি আসনে। এরপরে প্রচার হলো যে রাজ্যের সব আসনের পূনঃর্গণনা চেয়ে তারা নাকি আদালতের শরণাপন্ন হবে কিন্তু ফলপ্রকাশের পর দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও এখনও তারা আদালতে যেতে পারলেন না।

আসলে তাদের এই প্রচারগুলির সবক'টাই ছিল ক্যাডারদের ও ডোনারদের বোকা বানানো যাতে তারা জবাবদিহি চাইতে না পারে। এখন রাজ্যের দুই ক্যাবিনেট মন্ত্রী সহ চারজনকে গ্রেপ্তার করার যে খেলা চলছে সেটাও সেই distraction game এর অঙ্গ। তাই নারদা কেসে, CBI এর পক্ষ থেকে ২০১৯ সালে সংসদের স্পিকারদের কাছে মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারী, কাকলী ঘোষ দস্তিদারদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার অনুমতি চাওয়া হলেও আজ অবধি সেই অনুমতি পাওয়া যায়না। "বহুত হুয়া ভ্রষ্টাচার, আব কি বার মোদী সরকার" স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় আসা নরেন্দ্র মোদী যে ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে কতটা কঠোর তার প্রমাণ অগাস্তা ওয়েস্টল্যান্ড, 2G, এয়ারসেল ম্যাক্সিস থেকে সুনন্দা পুস্করের মৃত্যুর তদন্তেই প্রমাণিত। সারদা কেসে সুদীপ ব্যানার্জী, মদন মিত্র, তাপস পাল সহ বিভিন্ন অভিযুক্তরা বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হলেও তদন্তের কোন পরিণতি আজও হয়নি। তাই আজ CBI হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে, চারজনকে গ্রেপ্তার করে, হেফাজতে রাখার জন্যে যতই অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেলকে কলকাতা হাইকোর্টে নিয়ে আসুন, মোদী সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ থেকেই যাবে।

Monday, May 3, 2021

ঠোঁট ও কাপের ফাঁক

দলবদলু বা ভোলবদলুদের দিয়ে যে পশ্চিমবঙ্গ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়না সেই শিক্ষা, আশা করি, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পেয়েছেন। রাজীব ব্যানার্জী, রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, প্রবীর ঘোষাল বা বৈশালী ডালমিয়া, সব্যসাচী দত্ত, জিতেন্দ্র তিওয়ারি বা শীলভদ্র দত্তরা নিজেদের লার্জার দ্যান লাইফ ইমেজ বানাতে পেরেছিলেন কেবলমাত্র মমতা ব্যানার্জীর ইমেজ আর প্রশাসনিক সাহায্যকে মূলধন করে। তাদের ব্যক্তিগত সাপোর্ট বেস শূন্য।

একইভাবে, নন্দীগ্রামে হিন্দুদের উপর চরম অত্যাচার করা শুভেন্দু অধিকারী, যে দলবদল করেই হিন্দুত্ববাদীদের কাছে ব্লু আইড বয় হয়ে গিয়েছিল, কোনরকমে নিজের আসন রক্ষা করতে পারলেও পূর্ব মেদিনীপুরের ১৬টা আসনের মধ্যে ১০টা জিতে গিয়েছে তৃণমূল। যে লোকসভা থেকে শুভেন্দু দুইবার জয়ী হয়েছিলেন সেই তমলুক লোকসভার অন্তর্গত ৭টা বিধানসভার মধ্যে মাত্র দু'টোতে জিততে পেরেছে শুভেন্দুর নতুন দল। নন্দীগ্রামে মমতা ব্যানার্জীকে অন্তত ৫০ হাজার ভোটে না হারাতে পারলে রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার দাবী করা শুভেন্দু অধিকারী নিজের কথা রাখেন কিনা সেটা তো জনগণ নজরে রাখবেই সাথে এটাও মনে রাখতে হবে যে জনগণ কিন্তু সব মনে রাখে আর সময়মত শোধ দিয়ে দেয়।

বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ভেবেছিল যে আসাম আর ত্রিপুরার মত পশ্চিমবঙ্গেও দলবদলুরা আসলেই সরকার হেঁটে হেঁটে বাড়ি চলে আসবে আর তাদের সেই কল্পনায় হাওয়া দিয়েছিল এই রাজ্যের দায়িত্বে থাকা প্রাক্তন কিছু দলবদলুরা।  পরিণতিতে, বিজেপির আমও গেছে আর ছালাও গেছে। এরসাথে যোগ করুন বিজেপি নেতাদের মাত্রাছাড়া ঔদ্ধত্য। ক্ষমতায় আসার আগেই তাদের প্রতিটা আচরণে অহংকার চুইয়ে পড়েছে। সমর্থকরা সামান্য ক্ষোভ বা অভিমান প্রকাশ করলেই তাদের সাথে কুকুর- বেড়ালের মত ব্যবহার করেছে রাজ্য নেতা ও তাদের স্তাবকরা। এর মূল্য তো দিতেই হবে।

নির্বাচনে হারার পর, খুব প্রত্যাশিতভাবে, বিজেপি ও তার আইটি সেল সব দোষ দেবে মছলিখোর বাঙালীদের। সোশ্যাল মিডিয়াতে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরা নিদান দেবেন যে বাঙালীরা সহী হিন্দু নয়, তাই বিজেপিকে ভোট দেয়নি। অথচ ফলাফল যদি উল্টো হতো, তাহলে রাজ্য বিজেপিতে গজিয়ে উঠতো প্রচুর 'চাণক্য' আর সোশ্যাল মিডিয়ার যোদ্ধারা হয়ে উঠতেন কলিযুগের অর্জুন। কিন্তু হায়, সেরকম যেহেতু হয়নি তাই সব দোষ বঙ্গালীর। ব্যর্থতা বরাবরই অনাথ হয় আর এখানেও তার ব্যতিক্রম হবেনা। 

অনেকে বলতে পারেন যে ঊনিশের নির্বাচনে বিজেপি দলবদলুদের নিয়ে তো সাফল্য পেয়েছিল। তাদেরকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে ২০১৯এ দলবদলু নিয়েও সাফল্যলাভের দু'টো কারণ ছিল - ১. প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোদীর কোন বিকল্প না থাকা এবং ২. পুলবামা হামলা ও পরবর্তীতে বালাকোটে এয়ার স্ট্রাইক নিয়ে দেশজুড়ে জাতীয়তাবাদের জোয়ার। ২০২১ এ, এই রাজ্যের নির্বাচনে, মমতা ব্যানার্জীর বিকল্প মুখ কে? জনগণ যখন মমতাকে সরানোর জন্যে বোতাম টিপবে, তখন সে মমতার বদলে কার মুখ ভাববে, দিলীপ, শুভেন্দু, মুকুল, অর্জুন, লকেট, স্বপন নাকি অন্য কেউ? আগেও বহুবার বলেছি নির্দিষ্ট কোন মুখ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে যাওয়া মূর্খতা। সেই কথা যখন বলেছি তখন অনেক দলদাস আসাম, ত্রিপুরা বা উত্তরপ্রদেশের দৃষ্টান্ত দিয়ে, সেই সিদ্ধান্তকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করেছিল। তখন যেটা বলেছিলাম, এখনও সেটাই বলবো, প্রত্যেকটা রাজ্যের চরিত্র আলাদা, একটা কমন ফর্মুলা সব যায়গাতে চলেনা। তবে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের চিন্তার যায়গাটাও বুঝতে পারছি। কোন মুখ ঘোষণা করা হয়নি বলে আজ দলের বিধায়ক সংখ্যা তবু ৭৭ এ গেছে, মুখ বলে দিলে যে অন্তর্ঘাতের ফলাফল কি হতো সেটা শ্রী রামই জানেন।