Thursday, April 25, 2024

চাকরি বাতিল ও ন্যায় বিচার

ইংল্যান্ড ও আমেরিকার আইনের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা ভারতীয় বিচারব্যবস্থার অন্যতম ভিত্তি হল ইংল্যান্ডের বিখ্যাত আইনজ্ঞ স্যার উইলিয়াম ব্ল্যাকস্টোনের বিখ্যাত উক্তি-  "It is better that ten guilty persons escape than that one innocent suffer মানে একজন নিরপরাধ'কে শাস্তি দেয়ার থেকে দশজন অপরাধীর মুক্তি বেশী ভাল। অর্থাৎ, আইনের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো নিরপরাধ'কে সুরক্ষা দেয়া।


আমি দুঃখিত কিন্তু আমার মনে হচ্ছে যে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলার রায় দিতে গিয়ে মহামান্য কলকাতা হাইকোর্ট সেই মাপদন্ডকে উপেক্ষা করেছেন। অযোগ্য প্রার্থীদের সাথে যোগ্য প্রার্থীদেরও চাকরি খারিজ করার এবং প্রদেয় বেতন সুদ সহ ফেরত দেয়ার যে নির্দেশ আদালত দিয়েছেন সেটাকে আর যাই হোক, ন্যায় বলা যায়না।


প্রয়োজনীয় তথ্যের অপর্যাপ্ততা হোক বা অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলির অসহযোগিতা - আদালত যদি যোগ্য ও অযোগ্য প্রার্থীদের পৃথক করতে অপারগ হয়ে থাকেন সেক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব ছিল অসহযোগী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের থেকে এদের প্রদেয় বেতন পুনরুদ্ধার করা। আইনের মূল ভিত্তিই হলো Justice should not only be done but also appears to be done মানে ন্যায় শুধু হওয়াটাই যথেষ্ট নয়, সেটার অনুভূতিটাও থাকা দরকার। কিন্তু তথ্যের অভাবে পুরো প্যানেলই বাতিল করার এই সিদ্ধান্ত সেই মাথা ব্যাথা কমাতে মাথা কেটে ফেলারই নামান্তর।


বিচারপতিরা তাদের কলমের এক খোঁচায় প্রায় পঁচিশ হাজার লোকের চাকরি নিষিদ্ধ করে দিলেন যার মধ্যে বহু যোগ্য প্রার্থীও আছেন কিন্তু মজার কথা হলো যাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এতবড় দুর্নীতি হলো তাদের বিরুদ্ধে সেই বিচারপতিরা কোন শাস্তি ঘোষণা করলেননা কারণ সেটা আইনের অন্য ধারায়, অন্য আদালতে বিচার্য। সেই পৃথক বিচারপ্রক্রিয়াতে কি ধরণের দীর্ঘসূত্রিতা ও প্রহসন চলছে সেটা সাধারণ মানুষ দেখলেও আইনের দেবী চোখে কাপড় বেঁধে রেখেছেন। প্যানেলের যথার্থতা নির্ধারণ করা নিয়ে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট সময়সীমা বেঁধে দিলেও বেআইনি প্যানেল তৈরীতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার কোন সময়সীমা নেই। প্রশাসন ও শাসকদলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বের ইচ্ছা ও সহযোগিতা ছাড়া যে এতবড় দুর্নীতি সম্ভব নয় এটা জেনেও অন্যান্য রাজনৈতিক সমীকরণের কারণে সেই তদন্ত বিশ বাঁও জলে। 


এরপরেও যদি আপনি আমাকে বিচার বিভাগের ভূমিকায় উচ্ছ্বসিত হতে বলেন তাহলে আমি নাচার। বিচার বিভাগের দায়িত্ব ন্যায় বিচার করা। ভোটের ইস্যু বানিয়েই তার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়না।

Friday, April 5, 2024

চিনি গো চীনি তোমারে

ছোটবেলায়, সম্ভবত চাঁদমামা'তে, একটা গল্প পড়েছিলাম। পাটালিপুত্রে তখন প্রবল ক্ষমতাশালী সম্রাট ধননন্দের শাসন। তার প্রতাপ এতটাই ছিল যে তার সৈন্যদলের সাথে লড়াই করতে হবে শুনে বিশ্বজয় করতে বেরোনো আলেকজান্ডারের সৈন্যদলেও ভীতির সঞ্চার হয় এবং বিদ্রোহ দেখা দেয়। চন্দ্রগুপ্ত তাকে হারিয়ে ক্ষমতা দখলের আপ্রাণ চেষ্টা করছেন কিন্তু ধননন্দের সাথে এঁটে উঠতে পারছেননা। বারবার লড়াই করে বিপর্যস্ত চন্দ্রগুপ্ত তখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।


কপর্দকহীন এরূপ অবস্থায় তিনি নিজের পরিচয় গোপন করে একদিন খাবার ও বিশ্রামের জন্যে একটি সাধারণ নাগরিকের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। সেই গৃহস্থের বাড়িতে কেবল একজন মা তার দুই ছেলে'কে নিয়ে থাকতেন। রাত্রিবেলায় সেই মা তাঁর দুই ছেলের সাথে চন্দ্রগুপ্তকেও পঙতি ভোজনে বসিয়ে খিচুড়ি পরিবেশন করেছেন। খিচুড়িতে হাত দিয়েই চন্দ্রগুপ্ত হাত সরিয়ে নেন কারণ সেটা অত্যন্ত গরম ছিল। তার এই আচরণ দেখে পরিবেশনকারী মা বলেন, "বাছা, তোমার তো দেখছি চন্দ্রগুপ্তের মত অবস্থা।" 


খাওয়া মাথায় উঠলো চন্দ্রগুপ্তের। সে সচকিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, "মা, আপনি এই কথা বললেন কেন?" উত্তরে সেই মহিলা বলেন, "খিচুড়ি গরম হলে সরাসরি মাঝখানে হাত দিতে নেই, বিভিন্ন পাশ থেকে ঠান্ডা হওয়া খিচুড়ি আস্তে আস্তে খেয়ে মাঝের দিকে এগোতে হয়। চন্দ্রগুপ্তও সেই গরম খিচুড়ির মত ধননন্দের সাম্রাজ্যকে সরাসরি আক্রমণ করে ভুল করছেন।"


গল্পটির ঐতিহাসিক সত্যতা কতখানি তা জানিনা তবে তারপরই নাকি চন্দ্রগুপ্ত আবার নতুন উদ্যমে সেনা যোগাড় করেন এবং ধননন্দের সাম্রাজ্যের সীমান্ত অঞ্চলগুলি দখল করতে করতে পাটালিপুত্রে পৌছে ধননন্দকে পরাজিত করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে শিবাজি মহারাজও একই পদ্ধতিতে মোঘল সাম্রাজ্যের খন্ড খন্ড অংশ জয় করে হিন্দুপদপাদশাহী প্রতিষ্ঠা করেন।


চীন অরুণাচলের কয়েকটি যায়গার নাম বদলে দেয়া নিয়ে ভারতের প্রতিক্রিয়ায় যাদের রক্ত গরম হচ্ছেনা তাদের মনে রাখা উচিত যে মোদীও চীনের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের আগে তাকে বিভিন্ন যায়গায় দুর্বল করতে চাইবে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্থায়ী সদস্যপদের জন্যে জার্মানি, ব্রাজিল'কে নিয়ে লবি করা হোক বা চীনের মদতপুষ্ট সোমালিয়ার জলদস্যুদের থেকে প্রতিবেশী দেশের নাগরিকদের মুক্ত করানো, শ্রীলঙ্কার বন্দরে চীনের জাহাজের অবস্থানে বারণ করাই হোক বা অস্ট্রেলিয়া আর জাপানকে কূটনৈতিক সঙ্গী করে দক্ষিণ চীন সাগরে ভারসাম্য বজায় রাখা- কাজ কিন্তু চলছেই। আর এরমধ্যে চীন সীমান্ত পার করার চেষ্টা করলে খালিহাতেই তাদের বেধড়ক মার দিচ্ছে ভারতীয় সেনা। গল্পের সেই চন্দ্রগুপ্তের ভুল মোদী করবেন না।

Wednesday, April 3, 2024

গণতন্ত্র ও কালোপযোগী সিদ্ধান্ত

কোন জাতির উত্থান বা পতনের ক্ষেত্রে বংশগরিমা একটা বড় ভূমিকা পালন করে। আধুনিক বিশ্বের প্রাচীণতম গনতন্ত্র, আমেরিকা তার বংশপরিচয় দক্ষিণ ডাকোটা রাজ্যের রাশমোর পাহাড়ে খোদাই করে রেখেছে আর সেখানে উজ্জ্বল হয়ে আছে তাদের চার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াশিংটন, টমাস জেফারসন, আব্রাহাম লিংকন ও থিওডর রুজভেল্টের মুখ। অ্যান্টনি হোপসের কাহিনী অবলম্বনে ঝিন্দের বন্দী রচনার সময় শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন লিখেছিলেন যে "নাম দ্বারাই বংশপরিচয় স্বীকার করিলাম" তেমনি এই চার রাষ্ট্রপতির দ্বারাই আমেরিকা স্বীকার করেছে তার পরিচয়। 


ভারতের মত সুবিশাল ও ঐতিহ্যবাহী দেশের ক্ষেত্রে মাত্র চারটি নাম বাছা মুশকিল আর তাই আমি, ব্যক্তিগতভাবে, অন্তত দশ'টি নাম নেবো যারা আমাদের দেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পরিচায়ক। শ্রী রাম, শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধদেব, চৈতন্যদেব, গুরু গোবিন্দ সিং, শিবাজি, নেতাজী, বাবাসাহেব আম্বেদকর এবং সর্দার প্যাটেল। 


শ্রীরাম ও শ্রীকৃষ্ণ নিঃসন্দেহে আমাদের সাংস্কৃতিক পরম্পরার প্রতীক। হিন্দুদের নবম অবতার বলে স্বীকৃত বুদ্ধদেব এতটাই প্রভাবশালী যে তার মহিমা ব্যাখ্যা করা এই অধমের সাধ্যের বাইরে। পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাঁর মতবাদের ব্যপ্তিই তার পরিচায়ক। এরপর আসে ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা চৈতন্যদেব- যার মহিমায় সনাতন ধর্ম পরিচিত হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। গুরু গোবিন্দ সিং ও শিবাজি স্বাভাবিকভাবেই আসবেন তাদের স্বাধীনচেতা মনোভাব ও জাত্যাভিমানের কারণে। আর আধুনিক যুগে নেতাজী থাকবেন একটি পরাধীন জাতিকে শুধুমাত্র স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখানো নয়, সেটাকে প্রাপ্তির উপায় দেখিয়ে দেয়ার জন্যে। বাবাসাহেব থাকবেন তার দূরদর্শিতা ও স্বজাতিপ্রীতির কারণে যা শত প্রলোভন সত্ত্বেও তাঁকে ও তাঁর অনুগামীদের কোন বিদেশী মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট করেনি এবং সবশেষে থাকবে সর্দার প্যাটেলের নাম যিনি বিভিন্ন রাজন্যবর্গকে ভারতের অঙ্গীভূত হওয়ার দিশা দেখিয়েছিলেন।


দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা এতদিন স্বদেশী ঠাকুর ছেড়ে বিদেশী কুকুরের গুণগান করে গিয়েছি। ১০০০ বছরের পরাধীনতাকে মাত্র ২০০ বছরের পরাধীনতা ভেবে নিয়েছি যেখানে বাস্তব হলো যে ইসলামিক শাসনেও ভারতবর্ষ ততটাই পরাধীন ছিল যতটা ইংরেজ শাসনে। কতিপয় ধান্ধাবাজ লোক ইসলামের বদলে ইংরেজকে বাছার জন্যে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়'কে খলনায়ক হিসাবে দেখাতেই পারেন কিন্তু বাস্তবে সিরাজোদৌল্লার মত লম্পট ও স্বেচ্ছাচারী শাসকের থেকে মুক্তির জন্যে শুধু রাজা কৃষ্ণচন্দ্র নয়, তার সাথে রাণী ভবানী, জগৎশেঠ, রায়বল্লভ প্রমুখরাও সাথ দিয়েছিলেন কারণ সেই সময় বাঙালী সমাজ আজকের মত মানসিক স্থবিরতায় ভুগতোনা। 


শত অভিযোগ সত্ত্বেও বাম শাসনকে ছুঁড়ে ফেলার জন্যে বর্তমান বাঙালী সমাজের তিন দশকের বেশী সময় লেগেছিল এবং একইভাবে বর্তমান শাসককে ছুঁড়ে ফেলতেও বাঙালী সমাজের দ্বিধা স্পষ্ট। সৌভাগ্যক্রমে, সেই যুগের শাসকবর্গের মধ্যে এই দ্বিধা ছিলনা আর তাই তাঁরা যথাসময়ে যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।