Thursday, April 28, 2022

রাষ্ট্রীয় সম্মানের অন্যদিক

রাষ্ট্র প্রদত্ত যেকোন নাগরিক সম্মান আসলে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নীতির প্রতিফলন মাত্র। যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে তারা তাদের অনুগামী বা নির্বাচনে লাভের অঙ্ক কষেই প্রাপকদের তালিকা তৈরী করে। তাই পদ্ম সম্মান, ভারতরত্ন, দেশিকোত্তম, সাহিত্য অ্যাকাডেমি বা জাতীয় পুরস্কার নিয়ে আমি আর উচ্ছ্বসিত হতে পারিনা কারণ, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে, এগুলো আসলে আনুগত্যের পুরস্কার।


এই কারণেই কিশোর কুমার বা রাহুল দেব বর্মণ তাদের বিপরীত রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে কখনও পদ্ম সম্মান পাননি আবার দাউদের সাহায্যকারী হওয়া সত্ত্বেও ইউসুফ খান ওরফে দিলীপ কুমার বা শারদ পাওয়ার পদ্ম সম্মানে বিভূষিত হয়েছেন। বছর খানেক আগে যখন 'অ্যাওয়ার্ড ওয়াপসি' ট্রেন্ড হয়েছিল তখনও সেটার মূল প্রেরণা ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। এই কারণেই ২০১০ এ পদ্মশ্রী প্রাপকদের, যারমধ্যে রয়েছেন ওড়িশি নাচের অন্যতম কিংবদন্তি, অশীতিপর গুরু মায়াধর রাউত, সরকারের দেয়া বাসভবন ছাড়তে বাধ্য করতে পারেন।


হ্যাঁ, আমাদের পরিচিত বা একই বিষয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা কখনও এই সম্মানের জন্যে বিবেচিত হলে আমরা উৎফুল্ল হই, রাষ্ট্রপতি ভবনের জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান দেখে মুগ্ধ হই আর নিজেদের এই ভেবে আশ্বস্ত করি যে আমাদের কাজ অবশেষে সরকারি স্বীকৃতি পেল কিন্তু একটু ভেবে দেখুন তো সরকার মানে আসলে কি? সেটা কি নিছকই একটা রাজনৈতিক দলের বা তাদের মতাদর্শের প্রতিফলন নয়? প্রাচীনকালে যেভাবে একটা মেয়েকে ছোটবেলা থেকেই পরিমিত বিষ খাইয়ে তাকে বিষকন্যা করে তোলা হতো এখন সেই কাজ করে চলেছে লর্ড মেকলে প্রচলিত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। ছোটবেলা থেকেই আমাদের অবচেতনে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে যে সরকার, সংবিধান, গণতন্ত্র, আইন ব্যবস্থা ইত্যাদি অত্যন্ত পবিত্র ব্যাপার। এগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা অপরাধ, ক্ষেত্রবিশেষে দেশদ্রোহ।


কিন্তু ভেবে দেখুন এগুলো সবকটা রাজনৈতিক শাসনের অঙ্গ মাত্র। সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর। তথাকথিত পবিত্র সংবিধানকে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী হামেহাল বদলে নেয় শাসকদল। গণতন্ত্রের মহিমা স্পষ্ট হয়ে যায় যখন এক বোতল দেশী মদের বিনিময়ে ভোট নিশ্চিত হয়ে যায়। H.L. Wayland যথার্থই বলেছিলেন যে, "Universal suffrage without universal education will be a curse" মানে সর্বশিক্ষা ছাড়া সবার ভোটাধিকার মানে সেটা অভিশাপ। এখানে শিক্ষা মানে শুধু বিদ্যা নয়, চেতনাও জড়িত। এই চেতনার বৈষম্যের কারণেই ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির জন্যে আমেরিকার রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করতে হয় আর পেগাসাস বা নারদা বা তহেলকা'র পরেও আমরা নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান বজায় রাখি।


দেশের আইন ব্যবস্থাকেও আমরা অত্যন্ত পবিত্র বলে মানি কিন্তু কাজ করতে গিয়ে দেখেছি সেই সিস্টেমের মধ্যে কত ফাটল। অর্থের ভূমিকা ছাড়াও যশের প্রলোভন কিভাবে বিচারকে প্রভাবিত করে সেটা সামনে থেকে দেখেছি আর তাই দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি তার অবসরগ্রহণের চার মাসের মধ্যেই রাজ্যসভায় মনোনীত হলে আর অবাক হইনা। কিছু বিচারকের অবসরগ্রহণের পর বিভিন্ন কমিশনের প্রধান হয়,  জনগণের ট্যাক্সের টাকায়, পাঁচতারা জীবন যাপন প্রমাণ করে দেয় তাদের কর্মজীবনের নিরপেক্ষতা।


এইসব দেখার পর আর কোন 'রাষ্ট্রীয়' যা আদতে 'দলীয়' সম্মান আর প্রভাবিত করেনা। সেনাদের সম্মানও এই প্রভাব মুক্ত নয়। ল্যান্সনায়ক হেমরাজের সাথে হওয়া অন্যায়ের উদাহরণ দিয়ে ক্ষমতায় আসার আট বছর পরেও তার পরিবারের সাথে দেখা করেননা প্রধানমন্ত্রী অথচ বিনা আমন্ত্রণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে যেতে পারেন। শুধু হেমরাজ কেন, পাঠানকোট, উড়ি বা পুলবামা'র কোন শহীদের পরিবারের সাথেই দেখা করেননি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার কোন সদস্য অথচ ৪৪ রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের ঔরঙ্গজেব জঙ্গীদের আক্রমণে শহীদ হওয়া মাত্রই তার বাড়িতে পৌছে গিয়েছিলেন তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী, নির্মলা সীতারমণ সহ তদানীন্তন সেনাপ্রধান, বিপিন রাওয়াত। এরপরেও আপনারা যদি ভাবেন এটার মধ্যে রাজনীতি নেই, তবে তাই হোক। আমি এই ছেলেখেলাতে আর ভোলার ভুল করবনা।

Thursday, April 21, 2022

সামাজিক কার্যকর্তার প্রয়োজনীয়তা

আজ থেকে ঠিক চার বছর আগে, আজকের দিনেই, উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জের রাড়িয়া গ্রামে আয়োজিত এক জনসভাতে তপন'দার বক্তব্য ছিল যে "যুগে যুগে সমাজের জন্যে হিন্দু নেতা দরকার। রাজনীতি ও ক্ষমতায় গেলে সেই হিন্দু নেতা পরিচয়টা আর থাকবে না। রাজনৈতিক নেতা সমাজের প্রয়োজন মেটাতে পারেনা"।


এই বিষয় নিয়ে, কিছুদিন আগে, এক ভাতৃসম বন্ধুর সাথেও তার একটা পোস্টে আলোচনা হচ্ছিল। তার বক্তব্য ছিল যে সামাজিক পরিবর্তনের জন্যে সামাজিক কার্যকর্তাদের রাজনীতিতে আসা প্রয়োজন। সেটা করলেই, তার দাবী অনুযায়ী, সমাজের পরিবর্তন সম্ভব। আমি তার দাবীর সাথে সহমত হতে পারিনি কারণ রাজনীতির প্রাথমিক লক্ষ্য হলো যেকোন উপায়ে ক্ষমতা দখল করা। সমাজ সংস্কার রাজনীতির কাজ নয়, তার কাজ হলো বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতিকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা। ফলে, কোন সামাজিক কার্যকর্তা যখনই রাজনীতির মঞ্চে যাবেন দলীয় নীতি অনুযায়ী তারও প্রাথমিক লক্ষ্য হবে রাজনৈতিক লাভ। সেই ভাতৃসম বন্ধুর কথা যদি তর্কের খাতিরে মেনেও নেই যে রাজনীতিতে গেলেই নীতি নির্ধারকের ভূমিকা লাভ করতে পারবে সেক্ষেত্রে সেই পর্যায়ে পৌছানো পর্যন্ত তাকে নিজের সামাজিক দায়িত্বর বদলে রাজনীতিকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। কিন্তু এতেও নিশ্চয়তা নেই যে সেই ব্যক্তি দলে নীতি নির্ধারকের ভূমিকা লাভ করবেন কারণ তার সাথে, তারই মত আরও অনেকেই লাইনে থাকবে। আর সেই লাইনে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে শুধু নিষ্ঠাই যথেষ্ট নয়, অর্থ, যোগাযোগ, শীর্ষস্থানীয়দের নেকনজর ইত্যাদি বহু বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলতঃ, কোন একদিন রাজনীতিতে নীতি নির্ধারক হতে পারেন এই সম্ভাবনার ভিত্তিতে, মানে সম্পূর্ণ ভাগ্যের ভরসায়, সেই সামাজিক কার্যকর্তাকে নিজের সামাজিক দায়িত্বর বদলে রাজনীতি নিয়ে চলতে হবে।


সমাজের স্বার্থ নিয়ে সচেতন কোন কার্যকর্তা এই জুয়া খেলায় যোগ দিতে আগ্রহী হবেন না যদিনা তারা অর্থলোভী হন অথবা কোন পদ লাভের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্খা থাকে। এই কারণেই কোন একটা রাজনৈতিক দলের রঙ গায়ে লাগা মাত্রই সে আর হিন্দু নেতা থাকতে পারেনা, দলের নেতা হয়ে যায়। আর সেই দলের নেতা হিন্দুদের যতই রক্ত গরম করার ভাষণ দিন না কেন, তার সেই বক্তব্যের জন্যে দল বিরম্বনায় পড়লে তাকেই পিছু হাঁটতে হয়।


এই সহজ সত্যটা বুঝতে পেরেছে বলেই মুসলমানদের কোন সামাজিক বা ধর্মীয় নেতা সচরাচর প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যোগ দেন না, বরং রাজনীতিকে ব্যবহার করে কিভাবে নিজেদের সমাজের সুবিধা করে নেয়া যায় সেটা নিয়ে নিজেদের সমাজকে প্রশিক্ষণ দেন। তাই আজ তারা তথাকথিত সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন সরকারি সুবিধা বা প্রকল্পের লাভ পুরোপুরি নিতে পারেন। শাসকের জামার রঙের থেকে কৌমের স্বার্থ রক্ষা তাদের কাছে বেশী দরকারী। তাই OBC-A সংরক্ষণ থেকে মুসলমানদের UPSC পরীক্ষার জন্যে বিশেষ প্রশিক্ষণ, বিমানে জমজমের পানি আনা থেকে শাদী শগুনের উপহার - সবই তারা আদায় করে নিয়েছে। সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর মত কয়েকজন ব্যতিক্রম থাকলেও লক্ষ্য করে দেখবেন, জামায়েতের নেতা হিসাবে যে সিদ্দিকুল্লার এত দাপট ছিল যে তার সভায় IPS দের পিটালেও শাস্তি হতনা সেই লোকই মন্ত্রী হওয়ার পরে হারিয়ে গেছেন।


এই কারণেই, তপন'দার মত, আমিও বিশ্বাস করি যে সামাজিক ও ধর্মীয় কার্যকর্তাদের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যাওয়া উচিত নয় বরং তাদের দায়িত্ব হলো সমাজকে এমন সশক্ত করা যাতে সমাজ দলমত নির্বিশেষে রাজনৈতিক ক্ষমতার সুবিধা নিতে পারে। একজন রাজনৈতিক নেতার কার্যকাল ও পরিকল্পনার ব্যপ্তি একটা নির্বাচন থেকে পরের নির্বাচন পর্যন্ত কিন্তু একজন সামাজিক কার্যকর্তাকে অনেক বেশী দূরদর্শী হতেই হয়।

Saturday, April 9, 2022

মা অন্নপূর্ণা পূজা

"আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে"- বাঙালীর চিরন্তন এই প্রত্যাশাই মা অন্নপূর্ণা'র কাছে প্রকাশিত হয়েছিল ঈশ্বরী পাটনী রূপে। কিন্তু সন্তানকে দুধে-ভাতে রাখার জন্যে শুধু প্রত্যাশাই যথেষ্ট নয়, সেটাকে রূপায়িত করার জন্যে যথেষ্ট প্রয়োগ ক্ষমতাও থাকা দরকার। প্রত্যাশা তো একজন ভিখিরিরও থাকে কিন্তু প্রয়োগ ক্ষমতা বিহীন তার সেই প্রত্যাশা অন্য কারুর সদিচ্ছার উপর নির্ভরশীল। তাই প্রত্যাশা পূরণের জন্যে প্রয়োগ ক্ষমতা আবশ্যিক।


১৯৪৬ সালের ১০ই অক্টোবর, এক কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার দিন, অধুনা বাংলাদেশের নোয়াখালীতে হিন্দুরা যখন লক্ষ্মী পূজার আয়োজনে ব্যস্ত, তখনই তাদের উপর নেমে এসেছিল জেহাদিদের করাল থাবা। যে সন্তানদের দুধে-ভাতে রাখার জন্যে বাঙালী পূজা করছিল, সেই সন্তানদেরই ধর্ষিত, মৃত দেহ ছুঁড়ে ফেলা হয় তাদের সামনে। বাঙালী মহিলাদের পরামর্শ দেয়া হয় ধর্ষণের জ্বালা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করার। অহিংসার মোড়কে তাদের প্রতিশোধস্পৃহা ধ্বংস করা হয়। সন্তানকে দুধে-ভাতে রাখার স্বপ্ন দেখা বাঙালী নিজেদের সর্বস্ব হারিয়ে, শুধু নিজেদের হিন্দু পরিচয়টুকু বাঁচানোর জন্যে, বেছে নেয় উদ্বাস্তু জীবন।


দিন বদলেছে, কিন্তু সময় বদলায়নি। আজও যখন কালিয়াচক, ধুলাগড়, বাদুড়িয়া, আসানসোল বা তেলেনিপাড়াতে সেই জেহাদি আক্রমণ হয়, তখনও সেই হিন্দুদেরই সংযম বজায় রাখার পরামর্শ দেয়া হয়। টিকিয়াপাড়াতে পুলিশকে লাথি মারা ব্যক্তির বাড়িতে পৌছে যায় রেশন আর তেলেনিপাড়ার কথা সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রকাশ করে দেয়ার 'অপরাধে' পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করে। সুদূর উত্তর প্রদেশের আখলাক কে নিয়ে সবাই ব্যথিত হলেও রায়গঞ্জের টোটোন দাস, বাদুড়িয়ার নিতাই দাস, অশোকনগরের মৌসুমি বিশ্বাস, খড়গপুরের রোহিত তাঁতীদের কথা আমাদের বলাই হয়না। দিল্লীর নির্ভয়াকান্ডে, ধর্ষণ করেও মহঃ আফরোজ ছাড়া পেয়ে যায় শুধুমাত্র তার ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে অথচ বাদুড়িয়ার শৌভিক নাবালক হওয়া সত্ত্বেও পুলিশ তাকে অনায়াসেই জুভেনাইল হোমের বদলে, জেলে ঢুকিয়ে দেয়।


তাই আজ শুধু "সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে" প্রার্থনাই যথেষ্ট নয়, সন্তানের সাথে যেন কোন বঞ্চনা না হয়, একইসাথে সেটা সুনিশ্চিত করাটাও প্রয়োজন। আর এই বঞ্চনার অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় পাশ হওয়া OBC আইন। যে আইন আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া ব্যক্তিদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার সহায়ক হতে পারতো, সেটাকেই, ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে ব্যবহার করা হয়েছে আর প্রকৃত দাবীদারদের অগ্রাহ্য করে, একটা বিশেষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ও চাকরিতে অন্যান্যদের তুলনায় বাড়তি সুবিধা দেয়া হয়েছে। লক্ষ্যটা একদম স্পষ্ট, বছরের পর বছর ধরে, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ও চাকরিতে একটা বিশেষ সম্প্রদায়ের লোকের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়ে এমন একটা শৃঙ্খল তৈরী করা যেটা দিয়ে পুরো প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।


আজ আপনি নাহয় নিজের সন্তানকে খাঁটি দুধের বদলে জল মেশানো দুধ দিয়েই ভাত খাওয়াচ্ছেন, কিন্তু এই পরিস্থিতির যদি পরিবর্তন না ঘটানো হয়, তাহলে আপনার পরের প্রজন্মের সেই জল মেশানো দুধটা কেনার সামর্থ থাকবে তো? পুরো সিস্টেমটাই যদি একটা বিশেষ সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, আপনি সেই প্রশাসনের থেকে সুবিচার পাবেন তো? নোয়াখালীর বাঙালীরা পেয়েছিল? কাশ্মীরি পন্ডিতরা পেয়েছিল? বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের হিন্দুরা পাচ্ছে তো?


এই কারণেই শুধু প্রত্যাশা যথেষ্ট নয়, সেটা পূরণ করার ক্ষমতাও থাকা দরকার। আজ আত্মদীপ সেই বিভেদমূলক OBC আইনের বিরুদ্ধে এগিয়ে এসে, যেটা আরও আগেই করা উচিত ছিল, কলকাতা হাইকোর্টে সেই আইনকে বাতিল করার আবেদন জানিয়েছে। কিন্তু এই লড়াইটা শুধু আত্মদীপ-এর নয়, পশ্চিমবঙ্গের সব বাঙালীর কারণ বনে যখন আগুন লাগে, সেই আগুন কোন ভেদাভেদ করেনা। তাই আজ মা অন্নপূর্ণা পূজার দিন, যখন মায়ের পুজো করবেন তখন শুধু নিজের পরিবারের ধন, সম্পদ, সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য চেয়েই থেমে যাবেননা, সেগুলিকে রক্ষা করার মত শক্তিও যেন আপনার থেকে, সেটাও প্রার্থনা করুন। নাহলে পূর্ববঙ্গের বাঙালীদের মত, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীদের উদ্বাস্তু হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।

সবাইকে মা অন্নপূর্ণা পূজার শুভেচ্ছা জানাই।

Thursday, April 7, 2022

সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ

মেকলে প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সেটাতে শিক্ষিতদের ধারণা যে বৈদেশিক আক্রমণের আগে ভারতবর্ষে কখনই ঐক্য ছিলনা। দেশ বলে কোন ধারণা ছিলনা। ভারত নেহাতই ছিল কতগুলো রাজ্যের সমষ্টি। ইসলামিক ও ব্রিটিশ শাসনই নাকি ভারতবর্ষকে প্রথম একটা সম্পূর্ণ দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছে। তাই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী অনায়াসেই বলতে পারেন যে "We are a nation in making"। অর্থাৎ, ভারতে জাতি বা জাতীয় সত্বা বলে কিছু নেই, সেটা নাকি সবেমাত্র তৈরী হচ্ছে।


১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হলেও সাদা চামড়ার ব্রিটিশদের থেকে ক্ষমতা গেল বাদামী চামড়ার নব্য সাহেবদের হাতে। তারপর থেকে ক্ষমতায় যারাই থেকেছে তারা সেই কলোনিয়াল মানসিকতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। তাদের ধারণা অনুসারে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত না হলে তারা প্রকৃত শিক্ষিত নয়। দেশের সাধারণ মানুষের মঙ্গল কিসে হবে সেটা নির্ধারণ করার যোগ্যতা ও অধিকার একমাত্র তাদেরই আছে। একইসাথে তাদের ধারণা যে সংখ্যালঘুরা (পড়ুন মুসলমানদের) যাই করুক, তাদের রক্ষা করার দায় হিন্দুদের।


কিন্তু এখানে মজার কথা হল যে ভারতে বসবাসকারী মুসলমানরা এই দেশে ইসলামিক আগ্রাসনের আগের গৌরবময় ইতিহাস সম্পর্কে গর্বিত হওয়া তো দূরের কথা, আগ্রহী পর্যন্ত নয়। পাল যুগ, গুপ্ত যুগ, সেন যুগ তাদের আগ্রহ জাগায় না। অজন্তার গুহাচিত্র বা দক্ষিণ ভারতের মন্দিরশৈলী নিয়ে তাদের গর্ব নেই। চেঙ্গিস খান, তুঘলক, ঘোড়ি বা মোঘলদের মত বিদেশী ঠগ, গুন্ডা, হানাদারদের নিয়ে তারা গর্বিত হয় কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে, দেশের সংস্কৃতিকে রক্ষাকারী শিবাজি, রানা প্রতাপ, বিজয়নগরের হরিহর ও বুক্কো, শশাঙ্ক কে নিয়ে তাদের গর্ব হয়না। একমাত্র সঙ্গীত ছাড়া ভারতের আর কোন কলা - সেটা নির্মাণ শিল্প হোক, রন্ধন শিল্প হোক বা সাহিত্য - সম্পর্কেই তাদের আগ্রহ ছিলনা। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তাদের আগ্রহের কারণ হল আরবী সংস্কৃতিতে সঙ্গীতের কোন স্থান ছিলনা এবং দ্বিতীয়ত বহু সঙ্গীতশিল্পীই ভয়ে বা রাজঅনুগ্রহ লাভের জন্যে ইসলামের মতাবলম্বী হয়েছিলেন। কিন্তু তারপরেও তারা আশা করে যে হিন্দুদের উচিত ভারতমাতা ও দেবী সরস্বতীর নগ্ন ছবি আঁকা ফিদা হুসেনের ছবি দেখে মুগ্ধ হওয়া, ইকবালের মত হিন্দু বিরোধীর রচনা নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়া বা শায়েরী ও গজল শুনে "ওয়াহ ওয়াহ" করা।


ভারতের রাজনৈতিক শাসকদের এই ক্লীবতা এবং হিন্দু ধর্মগুরুদের সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে নিস্পৃহতাই হিন্দুদের ধীরে ধীরে দুর্বল করে দিয়েছে। ইসলামিক নিগ্রহকে তারা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মত অমোঘ ও অপ্রতিরোধ্য ভেবে নিয়েছে। তাই ১৯৮২ সালে, NCERT রীতিমতো ঘোষণা করে ভারতের ইতিহাস পুনর্লেখনের নামে ইতিহাস থেকে ভারতের গৌরবময় ইতিহাসের কথা, বিশেষত গুপ্তযুগের কথা বিশদে বাদ দেয়ার জন্যে সার্কুলার জারি করলেও হিন্দুদের স্বাভিমানে সেটা আঘাত করেনা। অথচ বাস্তব হলো যে প্রত্যেকটা জাতিরই একটা স্বর্ণযুগ থাকে। চীনের ক্ষেত্রে মিঙ সাম্রাজ্য, জার্মানির বিসমার্ক, ইংল্যান্ডের এলিজাবেথের শাসনের মতই ভারতে গুপ্ত যুগ একটা স্বর্ণযুগ যখন প্রতিটা ক্ষেত্রে জাতির বিকাশ ঘটেছিল। একইভাবে, ১৯৮৯ সালে, তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার সার্কুলার দিয়ে ইতিহাস থেকে মুসলমান আক্রমণের বর্বরতার কথা মুছে দিতে চাইলেও হিন্দু সমাজ নীরব থেকে যায় কারণ দীর্ঘ পরিকল্পনার মাধ্যমে তার জাতীয় পরিচয়কেই মুছিয়ে দেয়া হয়েছে।


এটা অত্যন্ত প্রশংসনীয় যে আজ রাজনৈতিক পালাবদলের সাথে, কেন্দ্রে মোদী সরকার আসার পরে, দেশের সামাজিক পরিস্থিতির কিছুটা হলেও উন্নতি ঘটেছে। না, রাজনৈতিক দলের উপর নির্ভর করে বা প্রশাসনের উপর ভরসা করে হিন্দুরা নিজেদের হৃতগৌরব ফেরাতে পারবেনা কিন্তু প্রদীপ জ্বালার আগে অন্তত সলতে পাকানোর কাজটা শুরু হয়েছে। যোগ বা আয়ুর্বেদের মত আবিস্কারের জন্যে বিশ্ব আবার ভারতের কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজের হিন্দু পরিচয়কে accidental birth বলার বদলে আত্মপরিচয় নিয়ে গর্ব প্রকাশ করছেন। তবে এতেই সন্তুষ্টির কোন যায়গা নেই কারণ এখনও বহু অসঙ্গতি রয়ে গেছে যেগুলো হিন্দু সমাজের জন্যে মঙ্গলকর নয়। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সাথে সামাজিক ক্ষমতায়ন না হওয়া অবধি বিশ্রামের সুযোগ নেই।