Saturday, August 24, 2019

আধার সংযুক্তি

প্রতিটা সোশাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের সাথে আধার যুক্ত করার জন্যে উদ্যোগ নিয়েছেন কেন্দ্র সরকার। এই উদ্যোগের পক্ষে তাদের যুক্তি হল যে, এর দ্বারা ভুয়ো অ্যাকাউন্ট তৈরী করা যাবেনা, ফলে প্রশাসনের পক্ষে কোন পোস্টের উৎসকে খুঁজে বের করা সহজ হবে। সরকারের মতে, এই লিঙ্কিং-এর ফলে সন্ত্রাসবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের চিহ্নিত করতে প্রশাসনের সুবিধা হবে।

সরকারের পক্ষ থেকে যতই নিরাপত্তার দোহাই দেয়া হোকনা কেন, প্রশাসনের যদি সদিচ্ছা থাকে তাহলে কোন অ্যাকাউন্টকে চিহ্নিত করার জন্যে তার IP address যথেষ্ট।  বর্তমানে নিজেদের IP address লুকানোর জন্যে অনেকেই VPN ব্যবহার করেন এটা ঠিক কিন্তু সেক্ষেত্রে আধারও কোনও ফুলপ্রুফ পদ্ধতি নয় যেখানে ভারতে আটক অধিকাংশ অনুপ্রবেশকারী বা জঙ্গীদের থেকে বাজেয়াপ্ত করা নথির মধ্যে আধার কার্ড হল অন্যতম কমন ডকুমেন্ট।

ভারতে আধার কার্ড মোটেই আমেরিকার সোশাল সিকিউরিটি নম্বরের মত সুরক্ষিত তথ্য নয় যেটার নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরিভাবে সরকারের কাছে রয়েছে। আধার বিল, যাকে 'মানি বিল' হিসাবে, রাজ্যসভার অনুমোদন ছাড়াই পাশ করা হয়েছে, সেখানে আধারের নিয়ন্ত্রণ দেয়া হয়েছে UIDAI নামক একটা স্বশাসিত সংস্থাকে। ভারতের মত দেশে, যেখানে প্রায় প্রতিটা, তথাকথিত, স্বশাসিত সংস্থা বাস্তবে সরকার মুখাপেক্ষী আর যে কারণে দেশের সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থা, CBI কেও দেশের সর্বোচ্চ আদালত 'খাঁচার তোতাপাখি' বলে, সেখানে তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। তবে স্বশাসিত সংস্থা বানানোর একটা মজা তো আছেই যে তাদের উপর বকলমে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকলেও, তাদের দায় সরকারকে নিতে হয়না।

২০১৬ সালে, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পরে জনসমক্ষে আসা, কেম্ব্রিজ অ্যানালেটিকা’র মত কোম্পানি তাদের কাছে প্রতিটা আমেরিকান ভোটারের অন্তত ৫০০০ ডাটা পয়েন্ট থাকার দাবী করেছিল। তার আগে, ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর নির্বাচনে, এই কেম্ব্রিজ অ্যানালেটিকা’র নেতৃত্বেই শুরু হয়েছিল "Do So" ক্যাম্পেইন। এই ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে অ্যাফ্রো-আমেরিকানদের মধ্যে রাজনীতি বিরোধী মানসিকতা গড়ে তোলা হয়, ফলে তারা ভোটদানে বিরত থাকে আর ইন্দো-আমেরিকানদের ভোটে ক্ষমতায় আসেন নতুন সরকার। Leave.EU ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে, ব্রিটেনে ব্রেক্সিটের পক্ষেও জনমত গড়ে তুলতে বড় ভূমিকা নেয় এই কেম্ব্রিজ অ্যানালেটিকা।

যাবতীয় তথ্য সামনে আসার পরে, তদন্ত থেকে বাঁচতে, সেই কোম্পানিটি বন্ধ করে দেয়া হলেও, তাদের কাছে ইউজারদের কি ডাটা আছে, সেই তথ্য কোর্টের আদেশের পরেও প্রকাশ করেনি কোম্পানি। বরং মেট্রোপলিটন কোর্টে নিজেদের অক্ষমতা প্রকাশ করে, দোষ স্বীকার করেছে। আজকের তারিখে, আপনি ফেসবুক বা গুগলে যাই করছেন, তার রেকর্ড থেকে যাচ্ছে কোম্পানির কাছে। আপনি কাদের, কোন ছবি বা লেখা পছন্দ করছেন, কোন বিজ্ঞাপন দেখে স্ক্রোল করা থামাচ্ছেন, কোন সাইটে কতক্ষণ থাকছেন ইত্যাদি দিয়ে তৈরী হচ্ছে আপনার প্রোফাইল আর নির্বাচনের সময় সেই প্রোফাইল বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আর সেটারই ভিত্তিতে আপনার টাইমলাইনে আসছে আপনাকে প্রভাবিত করার তথ্য।

এমতাবস্থায়, সেগুলোর সাথে আধারকে যুক্ত করা মানে আপনার আর্থিক লেনদেনের চাবিকাঠিও তাদের হাতে তুলে দেয়া। বছরখানেক আগে একটি মামলায়, সুপ্রিমকোর্ট গোপনীয়তার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে, আধারের সাথে মোবাইল নম্বরের বা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সংযুক্তি বাধ্যতামূলক না করার পক্ষে রায় দিলেও, সরকার ঘুরপথে আবার সেই কাজেই ব্রতী হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট আধার আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা বাতিল করে, প্রাইভেট অপারেটরদের আধারের ডাটা ব্যবহার করার অধিকার কেড়ে নিয়ে, শুধু ব্যাঙ্ক আর নিয়ন্ত্রিত কিছু সংস্থাকে সেই অধিকার দিলেও, কেন্দ্রীয় সরকারের সোশ্যাল মিডিয়ার সাথে আধারের সংযুক্তির প্রস্তাব বাস্তবে কোর্টের আদেশের বিরুদ্ধেই যাচ্ছে।

গণতন্ত্র মানে পুলিসতন্ত্র নয়। আর ভারতের আইনের মূল স্পিরিটই হল যে ১০ দোষী যদি ছাড়া পায় তো পাক, কিন্তু একজন নির্দোষের যেন শাস্তি না হয়। অথচ বর্তমানে, নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে, সেই স্পিরিটকে বুড়ো আঙুল দেখাতে চাইছেন মোদী সরকার। বিরোধী শূন্য, একদলীয় সরকার গণতন্ত্রের পক্ষে কতটা লাভজনক সেটা ক্রমেই দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

https://eisamay.indiatimes.com/west-bengal-news/others/aadhaar-social-media/articleshow/70759327.cms