Sunday, August 23, 2020

বাকস্বাধীনতা

 ভারতের বিচার ব্যবস্থা একটা যুগসন্ধিক্ষণের মুখে দাঁড়িয়ে আছে আর এই পরিস্থিতি তৈরী হয়ে বিখ্যাত আইনজীবী, প্রশান্ত ভূষণের দু'টি ট্যুইটের পরিপ্রেক্ষিতে। নিজের ট্যুইটে ভূষণ সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা এবং প্রধান বিচারপতির আচরণ নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তোলেন। তাঁর এই ট্যুইটের প্রেক্ষিতে, সর্বোচ্চ আদালত, বিচারপতি অরুণ মিশ্রর নেতৃত্বাধীন একটা বেঞ্চের অধীনে, ভূষণের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে, আদালত অবমাননার মামলা করেন। নিজেদের এই মামলা থেকে বাঁচাতে ট্যুইটার স্বতঃপ্রণোদিতভাবে প্রশান্ত ভূষণের ট্যুইটগুলি ইতিমধ্যেই মুছে দিলেও বিতর্ক এতে থামেনি, বরং ইন্টারনেটে বাকস্বাধীনতার হয়ে সওয়াল করা Internet Freedom Foundation ট্যুইটার ইন্ডিয়াকে এই আচরণের জন্যে সমালোচনা করেছে। ভূষণের করা এই ট্যুইটের ভিত্তিতে, আদালতের নেয়া অবস্থানের ভিত্তিতেই প্রশ্ন উঠেছে যে বাকস্বাধীনতার সীমা কতটা এবং ভারতের বিচার বিভাগ কি সমালোচনার উর্ধ্বে? 


এই বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতে প্রশান্ত ভূষণের হয়ে দাঁড়িয়েছেন আরেকজন বিখ্যাত আইনজীবী, দুষ্ম্যত্ম দাভে। আদালতে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সওয়াল করেছেন যে ভূষণের ট্যুইট বাকস্বাধীনতার সীমাকে মোটেই অতিক্রম করেনি বরং আদালতই নিজের ক্ষমতার সীমারেখা অতিক্রম করে এই মামলা করেছে। দাভের যুক্তির সামনে বিচারপতি মিশ্রকেও বলতে হয়েছে যে তিনি নিজেও বাকস্বাধীনতার পক্ষপাতী আর সেই কারণেই তাঁর ২০ বছরের চাকরি জীবনে এটাই প্রথম আদালত অবমাননার মামলা যেটা তিনি গ্রহণ করেছেন।


এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে প্রশান্ত ভূষণের ট্যুইট কি সত্যিই আদালতকে অবমাননা করেছে? এই প্রসঙ্গে বিচার চলাকালীন বিচারপতি মন্তব্য করেছেন যে তাঁর এই ট্যুইটের ফলে নাকি ভারতের বিচার ব্যবস্থার কাঠামো নড়ে গেছে। এটাই যদি বাস্তব হয়ে থাকে তাহলে তো এটাই এখন থেকে ট্যুইটারের বিজ্ঞাপন হওয়া উচিত যে তাদের মঞ্চ এতটাই শক্তিশালী যে সেটা বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের বিচার ব্যবস্থাকে পর্যন্ত নাড়িয়ে দিতে পারে। তাই এইসব হালকা মন্তব্যে কান না দিয়ে যদি কেসের মেরিট ধরে বিচার করা হয় তাহলে কি এটা অস্বীকার কোন যায়গা আছে যে বিগত কয়েক বছরে, দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় এমন সব আদেশ জারি করেছেন যেটা মোটেই আমাদের দেশের বিচার বিভাগের মূলমন্ত্র, সত্যমেব জয়তে-র সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়?


উদাহরণ স্বরূপ আসাম NRC এর উদাহরণ টানা যেতে পারে যেখানে তদানীন্তন প্রধান বিচারপতির অঙ্গুলিহেলনে পরিচালিত হয়েছিল সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া আর টার্গেট করা হয়েছিল বাঙালি হিন্দুদের? একইভাবে রামজন্মভূমি মামলাতে, সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাচারীর মত, ওয়াকফ বোর্ডকে দেয়া হয়েছে জমি। একটা জমির টাইটেল স্যুট সংক্রান্ত মামলায়, যে পক্ষ নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে, তারই তো জমির মালিকানা পাওয়া উচিত। একইভাবে, জাল্লিকাট্টু থেকে শবরীমালা, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিতাড়ন থেকে শনি সিংনাপুর মন্দির, প্রতিটা ক্ষেত্রেই বিচার বিভাগের অতি সক্রিয়তা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। PM Care Fund, যেখানে কোটি কোটি টাকা জমা হয়েছে এবং সেই সংক্রান্ত আইনকে retrospective, মানে আইন আজ পাশ হলেও বলবৎ হবে আগের থেকে, ভিত্তিতে পরিবর্তন করা হচ্ছে আর তার সাথে সরকারি ফান্ড বলে সেটাতে CSR এর টাকা নেয়ার পরেও সেই ফান্ডকে RTI এবং CAG থেকে আড়াল করা হচ্ছে, তখন সেই ফান্ডের স্বচ্ছতার ব্যাপারে সর্বোচ্চ আদালতের ভূমিকা কি? এই প্রসঙ্গে প্রশান্ত ভূষণের দ্বারা পুরনো একটা সাক্ষাৎকারে বিচারকদের দুর্নীতি নিয়ে করা অভিযোগকেও টেনে আনা হয়েছে। মজার কথা হচ্ছে এই বিষয়ে কয়েকদিন আগেই বম্বে বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন সভাপতি, ইকবাল চাগলা, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কাগজে লিখেছেন যে তাঁর সভাপতিত্বেই বার অ্যাসোসিয়েশন পাঁচ জন বিচারককে দুর্নীতির সাথে যুক্ত বলে রেজোল্যুশন পাশ করেন। আর হ্যাঁ, দুর্নীতি সবসময়ই যে টাকা নিয়ে হবে সেটা নয়, টাকার বদলে কোন পদ, বা পরিবারের কারুর কোন সুবিধা করে দেয়া ইত্যাদিও দুর্নীতির অঙ্গ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে অবসর গ্রহণের কিছুদিন পরেই, ভারতের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি, রঞ্জন গোগোই, সংসদের উচ্চ কক্ষের সদস্য হিসাবে মনোনীত হন।


এই মামলায় আদালত কতটা মরিয়া হয়ে গেছে সেটা একটা বিষয় উল্লেখ করলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে যে বিচারপতিরা দেশের প্রধান অধিবক্তা বা অ্যাটর্নি জেনারেল, শ্রী বেনুগোপালকেও আদালতে তাঁর সম্পূর্ণ বক্তব্য পেশ করতে দিচ্ছেন না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে অ্যাটর্নি জেনারেল কিন্তু সরকারের প্রতিনিধি নন, সেই কাজ সলিসিটর জেনারেল করেন, বরং তিনি দেশের সর্বোচ্চ জুডিশিয়াল অফিসার যার দায়িত্ব সংবিধানের ভিত্তিতে সরকার ও বিচার বিভাগকে উপযুক্ত পরামর্শ দেয়া। আর সেই অ্যাটর্নি জেনারেল যখন আদালতে দাঁড়িয়ে ভূষণের স্বপক্ষে কথা বলছেন, তখন শুধু তাকে থামিয়ে দেয়া হচ্ছে তাই নয়, আদালতের রেকর্ডে তাঁর নামের উল্লেখও থাকছেনা। পরে নিজেদের ভুল বুঝে সেটা সংশোধন করা হয়।


এই প্রসঙ্গে এটা উল্লেখ করে রাখি যে আদালত অবমাননার দায়ে এই অধমের বিরুদ্ধেও হয়তো আগামীকাল মামলা হতে পারে কারণ গত ২১শে আগস্ট, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সংক্রান্ত একটা মামলার রায় দিতে গিয়ে, সর্বোচ্চ আদালত সেই ব্যক্তির আর পদে না থাকার যে বালখিল্য যুক্তি দিয়ে, মামলাটা খারিজ করেছেন সেটা আমার কাছে হাস্যকর। কোন ব্যক্তি আর সেই পদে নেই বলে, তার বিরুদ্ধে সেই পদের অপব্যবহার সংক্রান্ত কোন অভিযোগ করা যাবেনা এই যুক্তি মানলে তো একটা প্রশাসনিক রদবদল ঘটালেই যেকোন সরকারি কর্মীর অপরাধ মার্জিত হয়ে যাবে। এই যুক্তিতে তো 2G কেসে টেলিকম মন্ত্রী থাকাকালীন ডি রাজা বা অগাস্তা হেলিকপ্টার কেসে ভারতীয় বায়ুসেনার তৎকালীন প্রধান, ত্যাগীর বিরুদ্ধে সহ সারদা, নারদা ইত্যাদি কেসে অনেকের বিরুদ্ধেই আর কোন তদন্ত হওয়া উচিত নয়, কারণ তারা আর সেই পদে নেই।


বিচার বিভাগের প্রতি প্রত্যেক নাগরিকের অবশ্যই সম্মান থাকা উচিত কিন্তু সেই সম্মান বজায় রাখার দায়িত্ব স্বয়ং বিচার বিভাগের। এই বিষয়ে Collector Land Acquisition vs Mst. Katiji & Ors মামলায় (AIR 1987, SC 1353) আদালত নিজেই স্পষ্টাক্ষরে লিখেছেন যে, "It must be grasped that judiciary is respected not on account of its power to legalize injustice on technical grounds but because it is capable of removing injustice and is expected to do so."। এই প্রসঙ্গে একটা ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ করে এই লেখা শেষ করছি। Emperor vs Tilak [(1908) 10 BOMLR 848] মামলা, যার শুনানি ১৩ই জুলাই থেকে ২২শে জুলাই অবধি ৮ দিন ধরে হাইকোর্টে চলেছিল। মামলাতে লোকমান্য তিলকের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন সেই সময় কলকাতা হাইকোর্টের বিখ্যাত ব্যারিস্টার, LP Evans Pugh এবং Garth। শুনানির কিছু পর্যায়ে মহম্মদ আলি জিন্নাহও তিলকের হয়ে সওয়াল করেন। শুনানি শেষ হলে, মামলার পার্সি বিচারপতি ডাবর, সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাচারীর মত, জুড়িদের প্রতি বিশেষ নির্দেশ প্রদান করেন আর সেই নির্দেশে তিনি বলেন যে, "“If one talks of patriotism in connection with bombs, bombs that effect murders, you are the judges of the question whether such a discussion tends or does not tend to bring Government established by law in India into hatred or contempt in the minds of the readers.”। এই নির্দেশের ফলে জুড়িদের রায় ৭-২ হিসাবে খন্ডিত হয় আর সেই খন্ডিত রায়ের ফলে, তিনি নিজের বিশেষাধিকার প্রয়োগ করে, লোকমান্য তিলককে, তাঁর কেশরী পত্রিকায়, বাংলায় সহিংস বিপ্লবী আন্দোলনকে সমর্থন করে লেখার জন্যে ছয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন। 


ডাবরের এই রায়ে খুশী হয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তাকে নাইটহুড উপাদি দেয় এবং বম্বে বার অ্যাসোসিয়েশন তার সম্মানে ডিনারের আয়োজন করে। এই খবর জিন্নাহর চেম্বারে আসা মাত্রই তিনি ক্ষুরধার ভাষায় বার অ্যাসোসিয়েশনকে চিঠি লেখেন যে "the Bar should be ashamed to want to give a dinner to a judge who had obtained a knighthood by doing what the Government wanted and by sending a great patriot to jail." অর্থাৎ তিলকের মত দেশভক্তকে কারাদণ্ডাদেশ দেয়া আর সরকারের পদলেহন করে নাইটহুড পাওয়া ব্যক্তির সম্মানে ডিনার আয়োজন করার জন্যে বার অ্যাসোসিয়েশনের লজ্জা হওয়া উচিত।


লেখার শেষ করবো Evelyn Beatrice Hall নাম্নী এক লেখিকার, যিনি S.G. Tallentyre ছদ্মনামে লিখতেন, বিখ্যাত সেই উক্তি দিয়ে, "I do not agree with what you have to say, but I'll defend to the death your right to say it" মানে অপরের বক্তব্য আমার মনের মত নাও হতে পারে কিন্তু তার বক্তব্য রাখার অধিকারকে আমি কখনই অস্বীকার করতে পারিনা। বিচারালয় হোক বা প্রশাসন, তারা যদি ক্ষেত্রবিশেষে চুপ থাকে আর ক্ষেত্রবিশেষে মুখর হয়, তাহলে সেটা অন্যায়।

Sunday, August 16, 2020

প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস

প্রতি বছর ১৬ই আগস্ট আমাদের ১৯৪৬ সালের ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে'র কথা মনে করিয়ে দেয় আর প্রশ্ন তোলে যে আমরা কতটা প্রস্তুত আছি। সেদিন জিন্নাহর আহ্বানে হওয়া প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের মর্ম হিন্দুরা প্রথমে বুঝতে পারেনি। তারা ভেবেছিল যে সেটা কোনও ছুটির দিন। তাদের ভুল ভাঙলো যখন সংযুক্ত বাংলার তদানীন্তন প্রধান, সোহরাওয়ার্দীর প্রত্যক্ষ মদতে, কলকাতার অলিগলিতে, জেহাদিরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরীহ হিন্দুদের উপর। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং নামে কুখ্যাত সেই হত্যাকাণ্ডের সময়, বাংলার কষাই নামে কুখ্যাত সোহরাওয়ার্দীর আদেশে প্রশাসন ছিল নিষ্ক্রিয়। এই আক্রমণ আর কয়েকদিন চললে কলকাতা হিন্দু শূন্য হয়ে যেত যদি গোপাল পাঁঠা (মুখোপাধ্যায়), বিজয় সিং নাহারের মত হিন্দুরা, ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সমর্থনে, একযোগে রুখে না দাঁড়াতেন এবং জেহাদিদেরকে তাদের ভাষাতেই জবাব না দিতেন। হিন্দু প্রতিরোধ গড়ে ওঠার পরেই সোহরাওয়ার্দী সেনা নামাতে বাধ্য হন।

১৯৪৬ সালে প্রতিরোধের পরেও প্রায় ছয় দশক ধরে এই কলকাতাতেই বসবাস করেছিলেন গোপাল মুখোপাধ্যায় ওরফে গোপাল পাঁঠা কিন্তু না কোন রাজনৈতিক দল আর না কোন সামাজিক সংগঠন তাঁর কীর্তি ও প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ইতিহাস বাঙালীর কাছে তুলে ধরেনি। অ্যাকাডেমিক মহলে বা স্থানীয় এলাকায় তিনি পরিচিত নাম হলেও, আপামর বাঙালীর কাছে তিনি ছিলেন অপরিচিত। আর অ্যাকাডেমিক কারণেও যারা ১৯৪৬ সালের পরিকল্পিত হিন্দুহত্যা এবং পরবর্তীতে হিন্দুদের প্রতিরোধের কথা জেনেছিলেন, তাঁরাও বিষয়টা নিয়ে আর খুব বেশী এগোননি। তাই ২০০৫ সাল অবধি তিনি কলকাতাতে জীবিত থাকলেও, তাঁর একমাত্র সাক্ষাৎকারটাও একজন বিদেশীর নেয়া।

চাকা ঘুরতে শুরু করলো ২০১৩ সাল থেকে যখন প্রবাসী কিছু সমর্থকের প্রয়াসের পরিপ্রেক্ষিতে ৪৬ এর গণহত্যা ও গোপাল পাঁঠার ভূমিকা নিয়ে সরব হলেন হিন্দু সংহতির প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, স্বর্গীয় তপন ঘোষ। তার পর থেকে, ২০১৮ সাল পর্যন্ত, প্রতি বছর মুসলিম লীগের ডাকে হওয়া প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস আর হিন্দুদের প্রতিরোধের স্মৃতিতে আয়োজিত হয়েছে অনুষ্ঠান। সেই বিশেষ দিনটা তে, কলকাতার রাস্তায় দাপিয়ে বেড়িয়েছে গোপাল পাঁঠার উত্তরাধিকারীরা। বাঙালীকে তাঁর ভুলে যাওয়া ইতিহাস এবং লড়াইয়ের সাফল্য পুনরায় মনে করিয়ে দিয়েছিল তপন দা।

তাঁর এই লড়াই সহজ ছিলনা। সমাজের বিভিন্ন হিন্দু বিরোধী শক্তির সাথে সাথে, হিন্দুত্বের তথাকথিত ধ্বজাধারী দলটিও তপনদার এই অনুষ্ঠান কে ব্যর্থ করতে উদ্যোগী হয়েছিল। ২০১৪ সালের এই বিশেষ দিনটাতেই, হঠাৎ তাদের ফুটবল প্রেম জেগে উঠেছিল। তাদের দলের সমর্থকরা যাতে তপনদার অনুষ্ঠানে না যায়, সেই জন্যে সেই বছর ১৬ আগস্ট আয়োজিত হয়েছিল পদযাত্রা। আর সেই পদযাত্রার সামনের সারিতে ছিলেন তৎকালীন রাজ্য বিজেপির এক নেতা যিনি বর্তমানে পূর্ব ভারতের একটা রাজ্যে রাজ্যপাল হিসাবে নিযুক্ত আছেন এবং তপনদার প্রয়াণের পর, সোশাল মিডিয়ায় আয়োজিত বিভিন্ন ওয়েবিনারে সুন্দর সুন্দর কথা বলে আসছেন। যাই হোক, তপনদার সভার সাফল্যে দেখে, সেই ফুটবল প্রেম আর টেঁকেনি আর তপনদার সৌজন্যে আজ বাঙালীও পেয়ে গেছে তাদের নিজস্ব আইকন।

Sunday, August 9, 2020

প্রাইভেট চ্যাট

কোন মতবাদ বা দর্শনের সাফল্য সেটায় বিশ্বাসীদের মানব সম্পদের উপর নির্ভরশীল। আমার বা আপনার কাছে সেই মতবাদ বা দর্শন ভুল বা অযৌক্তিক হতেই পারে কিন্তু সেটা সেই মতবাদের প্রসারণের ক্ষেত্রে determining factor নয়। উদাহরণ স্বরূপ ইসলাম বা বৈষ্ণবদের কথা বলা যেতে পারে। বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এদের প্রসার ঘটেছে কারণ এদের অনুগামীরা এই মতবাদের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ আর সেটা প্রসারের জন্যে তাঁরা যেকোন পর্যায়ে যেতে পারেন।


এর সম্ভবত একটা কারণ মতবাদগুলির rigidity। তার ফলে, এদের অনুগামীদের কাছে সবকিছুই হয় সাদা, নয় কালো, মাঝামাঝি কোন স্থান নেই। উল্টো  দিকে সনাতন সংস্কৃতি অনেক বেশী flexible। সেখানে সাদা আর কালোর মিশেলে ধুসর রঙের অস্তিত্বও স্বীকৃত। এই flexibility ই এককালে সনাতন ধর্মের প্রসারে সহায়ক হয়েছে আবার এটাই সেই সেই ধর্মের ক্ষয়িষ্ণুতার অন্যতম কারণ। একই সংস্কৃতি যে কারণে প্রসারিত হয়েছে, সেই কারণেই সঙ্কুচিত হয়েছে এটা বোঝা একটু কষ্টকর আর সেখানেই আসে অনুগামীদের ভূমিকা।


অনুগামীরা যদি সংস্কৃতি বা দর্শনের প্রতি আন্তরিকভাবে বিশ্বাসী না হয়, কেবলমাত্র ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে সেই সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে থাকে বা ব্যবহার করে থাকে, তাহলে এই পরিণতি স্বাভাবিক। উদাহরণ স্বরূপ পশ্চিম বা উত্তর ভারতের বেশ কিছু পরিবারের কথা বলা যায় যারা নিজেদের বাড়িতে নিরামিষ ভোজন করলেও বাইরে অনায়াসেই আমিষ খেয়ে থাকেন। কেউ আমিষ খাবেন না নিরামিষ সেটা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত কিন্তু সম্পত্তি পাওয়ার স্বার্থে, বাড়ির বয়স্কদের খুশি রাখার জন্যে বাড়িতে নিরামিষ খাওয়া আর বাইরে আমিষ খাওয়া - এটা নিছক প্রতারণা, সাদা বাংলায় hypocrisy।


একইভাবে, যারা নিজেদের পাব্লিক পোস্টে, জনগণকে হিন্দুত্ব ও বাঙালিত্বর তত্ত্ব ও আদর্শ নিয়ে গুরুগম্ভীর বাণী বিতরণ করে থাকেন আর প্রাইভেটলি মহিলাদের নিয়ে, এমন বোন সম্পর্কের মেয়েদের নিয়েও, ধারাবাহিকভাবে নোংরামি করে চলে আর সেই কথা প্রকাশ্যে চলে আসলে, যার মাধ্যমে বাইরে এসেছে তাকে টার্গেট করার জন্যে জেহাদিদের কাছে আমন্ত্রণ জানায়, মাফ করবেন, তারা আমার কাছে "take it easy" নেয়ার মত নয়। একইসাথে, যেসব বিদগ্ধজনেরা এই ঘটনাকে "shit happens" বলে লঘু করে দেয়ার চেষ্টা করছে তাদের দেখে, হিন্দু মহিলাদের উপর জেহাদিদের দ্বারা হওয়া অত্যাচারের প্রেক্ষিতে, মুসলমানদের উচ্চবর্গের প্রতিবাদ বিহীন থাকার কারণ নিয়ে লেখা শরৎচন্দ্রের সেই কথা মনে পড়ে যাচ্ছে যে "বাপু, সুযোগ পাইলে তো আমিও ঐ কাজই করিতাম"।

Thursday, August 6, 2020

প্রশাসন দখল

হিন্দুরা যখন নরেন্দ্র মোদীর হাতে ধরে শ্রী রাম মন্দিরের ভূমি পূজন নিয়ে উচ্ছসিত হচ্ছে ঠিক তখনই, সেই নরেন্দ্র মোদীর 'হুনর হাত' ধরে, খুবই সুপরিকল্পিত উপায়ে, কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক মহলে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব বাড়িয়ে চলেছে মুসলমানরা। ২০১৬ সালে যেখানে UPSC তে সফল হওয়া মুসলমান প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ২.৫%, মাত্র ৪ বছরের মধ্যেই সেটা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। 

এই বছর UPSC তে সফল হওয়া ৪০ জন মুসলমান প্রার্থীর মধ্যে ২৭ জনই হলো জাকাত ফাউন্ডেশনের শিক্ষার্থী। জাকাত ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন শিকাগো নিবাসী হালিল ডেমির আর এই সংস্থায় বার্ষিক অনুদানের পরিমাণ প্রায় ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

ভারতের প্রশাসনে এইভাবে বিদেশী পুঁজি আর বিদেশী সংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান অনুপ্রবেশ এবং আগামী দিনে সেটার পরিণতি নিয়ে কি নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ বা দেশবাসীরা আদৌও সচেতন?

https://www.news18.com/news/india/upsc-registers-40-increase-in-number-of-successful-muslim-candidates-this-year-2758205.html

Saturday, August 1, 2020

ধর্মের লড়াই

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগেই শ্রীকৃষ্ণ ঘোষণা করেছিলেন যে সেই যুদ্ধে তিনি অস্ত্র ধারণ করবেননা। তাঁর এই ঘোষণাই দুর্যোধনকে উদ্বুদ্ধ করেছিল নিরস্ত্র কৃষ্ণের বদলে আঠার অক্ষৌহিণী সৈন্য নিতে। কিন্তু যুদ্ধের অষ্টম দিন ভীষ্ম যখন যুদ্ধক্ষেত্রে পান্ডবসেনার সামনে মূর্তিমান ত্রাসের মত আবির্ভূত হলেন, তাঁর অনন্য যুদ্ধশৈলীর প্রভাবে পান্ডবসেনারা যখন প্রবল ঝড়ের সামনে শুকনো পাতার মত উড়ে যেতে লাগলো এবং অর্জুন সহ পান্ডবদের সমস্ত মহারথীরা যখন দিশেহারা তখন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে তার বীরত্বের মিথ্যা অহংকারের জন্যে তিরস্কার করলেন। এরপর তিনি আপন প্রতিজ্ঞা ভুলে, নিজের সারথির আসন ছেড়ে একটি ভেঙে যাওয়া রথের চাকা নিয়ে ভীষ্মকে আক্রমন করলেন।

আক্রমনোদ্যত শ্রীকৃষ্ণকে দেখেই ভীষ্ম নিজের অস্ত্র ত্যাগ করলেন। ভয়ে নয়, ভক্তিতে। এরপর তিনি করজোড়ে কৃষ্ণকে তাঁর শপথের কথা স্মরণ করিয়ে বললেন যে তিনি যদি তাঁর প্রতিজ্ঞা পালন না করেন তাহলে সমাজ তাঁকে নিন্দা করবে। এর উত্তরে শ্রীকৃষ্ণ যা বলেছিলেন সে কথা কালজয়ী। ভীষ্মের কথার প্রত্যুত্তরে তিনি দার্ঢ্যপূর্ণ কন্ঠে বলেন যে “লড়াই যখন ধর্মের সাথে অধর্মের তখন ব্যক্তিসত্বা মূল্যহীন। আজ আপনি অধর্মের পক্ষ নিয়ে লড়াই করছেন আর ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্যে আপনার পরাজয় আবশ্যিক। তাই আপনাকে পরাজিত করার জন্যে যদি আমাকে নিজের প্রতিজ্ঞা ভেঙে অস্ত্র ধারণ করতে হয় তো আমি সেই কাজের দায় নিতে প্রস্তুত”। 

সত্য কি সেটা জেনেও সত্যের পাশে না দাঁড়ানোর জন্যে মূলত দু'টো বিষয় দায়ী। এক, অসত্যের প্রতি আসক্তি - সেটার কারণ বিভিন্ন হতে পারে, যেমন ব্যক্তিগত নিষ্ঠাকে সামাজিক দায়িত্বর উপরে স্থান দেয়া, অসত্য থেকে ক্ষণিকের লাভ, সত্যের সঙ্গ দেয়ার সাহসের অভাব ইত্যাদি। এবং দুই, চিন্তাভাবনার স্থিতিজাড্যতা। এই রোগে যারা আক্রান্ত তারা যত জ্ঞানীই হোক না কেন, সত্যের সঙ্গ দেয়ার সাহস তাদের থাকেনা। দুর্যোধন যেমন বলেছিলেন যে "জানামি ধর্মং অপি; নঃ চঃ মে প্রবৃত্তি, জানামি অধর্মং অপি; নঃ চঃ মে নিবৃত্তি", এরাও ঠিক তেমনই অধর্মকে জেনেও সেটার সঙ্গ দিয়ে চলে নিজেদের সাহসিকতার অভাবে।

মহাভারতের সময়ে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য প্রমূখরা ব্যক্তিগত ভাবে জ্ঞানী হলেও কুরুক্ষেত্রে তাঁরা অধর্মের পক্ষেই সামিল হয়েছিলেন আর তাই তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে অর্জুন দ্বিধাগ্রস্ত হলে, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ তাকে গীতার জ্ঞান প্রদান করেছিলেন। আজকে যারা অন্যায় কে জেনেও, নীরব থেকে সেটার পক্ষ নিচ্ছে, তাদের ধ্বংস কিভাবে হবে?