Sunday, August 23, 2020

বাকস্বাধীনতা

 ভারতের বিচার ব্যবস্থা একটা যুগসন্ধিক্ষণের মুখে দাঁড়িয়ে আছে আর এই পরিস্থিতি তৈরী হয়ে বিখ্যাত আইনজীবী, প্রশান্ত ভূষণের দু'টি ট্যুইটের পরিপ্রেক্ষিতে। নিজের ট্যুইটে ভূষণ সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা এবং প্রধান বিচারপতির আচরণ নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তোলেন। তাঁর এই ট্যুইটের প্রেক্ষিতে, সর্বোচ্চ আদালত, বিচারপতি অরুণ মিশ্রর নেতৃত্বাধীন একটা বেঞ্চের অধীনে, ভূষণের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে, আদালত অবমাননার মামলা করেন। নিজেদের এই মামলা থেকে বাঁচাতে ট্যুইটার স্বতঃপ্রণোদিতভাবে প্রশান্ত ভূষণের ট্যুইটগুলি ইতিমধ্যেই মুছে দিলেও বিতর্ক এতে থামেনি, বরং ইন্টারনেটে বাকস্বাধীনতার হয়ে সওয়াল করা Internet Freedom Foundation ট্যুইটার ইন্ডিয়াকে এই আচরণের জন্যে সমালোচনা করেছে। ভূষণের করা এই ট্যুইটের ভিত্তিতে, আদালতের নেয়া অবস্থানের ভিত্তিতেই প্রশ্ন উঠেছে যে বাকস্বাধীনতার সীমা কতটা এবং ভারতের বিচার বিভাগ কি সমালোচনার উর্ধ্বে? 


এই বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতে প্রশান্ত ভূষণের হয়ে দাঁড়িয়েছেন আরেকজন বিখ্যাত আইনজীবী, দুষ্ম্যত্ম দাভে। আদালতে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সওয়াল করেছেন যে ভূষণের ট্যুইট বাকস্বাধীনতার সীমাকে মোটেই অতিক্রম করেনি বরং আদালতই নিজের ক্ষমতার সীমারেখা অতিক্রম করে এই মামলা করেছে। দাভের যুক্তির সামনে বিচারপতি মিশ্রকেও বলতে হয়েছে যে তিনি নিজেও বাকস্বাধীনতার পক্ষপাতী আর সেই কারণেই তাঁর ২০ বছরের চাকরি জীবনে এটাই প্রথম আদালত অবমাননার মামলা যেটা তিনি গ্রহণ করেছেন।


এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে প্রশান্ত ভূষণের ট্যুইট কি সত্যিই আদালতকে অবমাননা করেছে? এই প্রসঙ্গে বিচার চলাকালীন বিচারপতি মন্তব্য করেছেন যে তাঁর এই ট্যুইটের ফলে নাকি ভারতের বিচার ব্যবস্থার কাঠামো নড়ে গেছে। এটাই যদি বাস্তব হয়ে থাকে তাহলে তো এটাই এখন থেকে ট্যুইটারের বিজ্ঞাপন হওয়া উচিত যে তাদের মঞ্চ এতটাই শক্তিশালী যে সেটা বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের বিচার ব্যবস্থাকে পর্যন্ত নাড়িয়ে দিতে পারে। তাই এইসব হালকা মন্তব্যে কান না দিয়ে যদি কেসের মেরিট ধরে বিচার করা হয় তাহলে কি এটা অস্বীকার কোন যায়গা আছে যে বিগত কয়েক বছরে, দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় এমন সব আদেশ জারি করেছেন যেটা মোটেই আমাদের দেশের বিচার বিভাগের মূলমন্ত্র, সত্যমেব জয়তে-র সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়?


উদাহরণ স্বরূপ আসাম NRC এর উদাহরণ টানা যেতে পারে যেখানে তদানীন্তন প্রধান বিচারপতির অঙ্গুলিহেলনে পরিচালিত হয়েছিল সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া আর টার্গেট করা হয়েছিল বাঙালি হিন্দুদের? একইভাবে রামজন্মভূমি মামলাতে, সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাচারীর মত, ওয়াকফ বোর্ডকে দেয়া হয়েছে জমি। একটা জমির টাইটেল স্যুট সংক্রান্ত মামলায়, যে পক্ষ নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে, তারই তো জমির মালিকানা পাওয়া উচিত। একইভাবে, জাল্লিকাট্টু থেকে শবরীমালা, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিতাড়ন থেকে শনি সিংনাপুর মন্দির, প্রতিটা ক্ষেত্রেই বিচার বিভাগের অতি সক্রিয়তা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। PM Care Fund, যেখানে কোটি কোটি টাকা জমা হয়েছে এবং সেই সংক্রান্ত আইনকে retrospective, মানে আইন আজ পাশ হলেও বলবৎ হবে আগের থেকে, ভিত্তিতে পরিবর্তন করা হচ্ছে আর তার সাথে সরকারি ফান্ড বলে সেটাতে CSR এর টাকা নেয়ার পরেও সেই ফান্ডকে RTI এবং CAG থেকে আড়াল করা হচ্ছে, তখন সেই ফান্ডের স্বচ্ছতার ব্যাপারে সর্বোচ্চ আদালতের ভূমিকা কি? এই প্রসঙ্গে প্রশান্ত ভূষণের দ্বারা পুরনো একটা সাক্ষাৎকারে বিচারকদের দুর্নীতি নিয়ে করা অভিযোগকেও টেনে আনা হয়েছে। মজার কথা হচ্ছে এই বিষয়ে কয়েকদিন আগেই বম্বে বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন সভাপতি, ইকবাল চাগলা, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কাগজে লিখেছেন যে তাঁর সভাপতিত্বেই বার অ্যাসোসিয়েশন পাঁচ জন বিচারককে দুর্নীতির সাথে যুক্ত বলে রেজোল্যুশন পাশ করেন। আর হ্যাঁ, দুর্নীতি সবসময়ই যে টাকা নিয়ে হবে সেটা নয়, টাকার বদলে কোন পদ, বা পরিবারের কারুর কোন সুবিধা করে দেয়া ইত্যাদিও দুর্নীতির অঙ্গ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে অবসর গ্রহণের কিছুদিন পরেই, ভারতের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি, রঞ্জন গোগোই, সংসদের উচ্চ কক্ষের সদস্য হিসাবে মনোনীত হন।


এই মামলায় আদালত কতটা মরিয়া হয়ে গেছে সেটা একটা বিষয় উল্লেখ করলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে যে বিচারপতিরা দেশের প্রধান অধিবক্তা বা অ্যাটর্নি জেনারেল, শ্রী বেনুগোপালকেও আদালতে তাঁর সম্পূর্ণ বক্তব্য পেশ করতে দিচ্ছেন না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে অ্যাটর্নি জেনারেল কিন্তু সরকারের প্রতিনিধি নন, সেই কাজ সলিসিটর জেনারেল করেন, বরং তিনি দেশের সর্বোচ্চ জুডিশিয়াল অফিসার যার দায়িত্ব সংবিধানের ভিত্তিতে সরকার ও বিচার বিভাগকে উপযুক্ত পরামর্শ দেয়া। আর সেই অ্যাটর্নি জেনারেল যখন আদালতে দাঁড়িয়ে ভূষণের স্বপক্ষে কথা বলছেন, তখন শুধু তাকে থামিয়ে দেয়া হচ্ছে তাই নয়, আদালতের রেকর্ডে তাঁর নামের উল্লেখও থাকছেনা। পরে নিজেদের ভুল বুঝে সেটা সংশোধন করা হয়।


এই প্রসঙ্গে এটা উল্লেখ করে রাখি যে আদালত অবমাননার দায়ে এই অধমের বিরুদ্ধেও হয়তো আগামীকাল মামলা হতে পারে কারণ গত ২১শে আগস্ট, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সংক্রান্ত একটা মামলার রায় দিতে গিয়ে, সর্বোচ্চ আদালত সেই ব্যক্তির আর পদে না থাকার যে বালখিল্য যুক্তি দিয়ে, মামলাটা খারিজ করেছেন সেটা আমার কাছে হাস্যকর। কোন ব্যক্তি আর সেই পদে নেই বলে, তার বিরুদ্ধে সেই পদের অপব্যবহার সংক্রান্ত কোন অভিযোগ করা যাবেনা এই যুক্তি মানলে তো একটা প্রশাসনিক রদবদল ঘটালেই যেকোন সরকারি কর্মীর অপরাধ মার্জিত হয়ে যাবে। এই যুক্তিতে তো 2G কেসে টেলিকম মন্ত্রী থাকাকালীন ডি রাজা বা অগাস্তা হেলিকপ্টার কেসে ভারতীয় বায়ুসেনার তৎকালীন প্রধান, ত্যাগীর বিরুদ্ধে সহ সারদা, নারদা ইত্যাদি কেসে অনেকের বিরুদ্ধেই আর কোন তদন্ত হওয়া উচিত নয়, কারণ তারা আর সেই পদে নেই।


বিচার বিভাগের প্রতি প্রত্যেক নাগরিকের অবশ্যই সম্মান থাকা উচিত কিন্তু সেই সম্মান বজায় রাখার দায়িত্ব স্বয়ং বিচার বিভাগের। এই বিষয়ে Collector Land Acquisition vs Mst. Katiji & Ors মামলায় (AIR 1987, SC 1353) আদালত নিজেই স্পষ্টাক্ষরে লিখেছেন যে, "It must be grasped that judiciary is respected not on account of its power to legalize injustice on technical grounds but because it is capable of removing injustice and is expected to do so."। এই প্রসঙ্গে একটা ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ করে এই লেখা শেষ করছি। Emperor vs Tilak [(1908) 10 BOMLR 848] মামলা, যার শুনানি ১৩ই জুলাই থেকে ২২শে জুলাই অবধি ৮ দিন ধরে হাইকোর্টে চলেছিল। মামলাতে লোকমান্য তিলকের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন সেই সময় কলকাতা হাইকোর্টের বিখ্যাত ব্যারিস্টার, LP Evans Pugh এবং Garth। শুনানির কিছু পর্যায়ে মহম্মদ আলি জিন্নাহও তিলকের হয়ে সওয়াল করেন। শুনানি শেষ হলে, মামলার পার্সি বিচারপতি ডাবর, সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাচারীর মত, জুড়িদের প্রতি বিশেষ নির্দেশ প্রদান করেন আর সেই নির্দেশে তিনি বলেন যে, "“If one talks of patriotism in connection with bombs, bombs that effect murders, you are the judges of the question whether such a discussion tends or does not tend to bring Government established by law in India into hatred or contempt in the minds of the readers.”। এই নির্দেশের ফলে জুড়িদের রায় ৭-২ হিসাবে খন্ডিত হয় আর সেই খন্ডিত রায়ের ফলে, তিনি নিজের বিশেষাধিকার প্রয়োগ করে, লোকমান্য তিলককে, তাঁর কেশরী পত্রিকায়, বাংলায় সহিংস বিপ্লবী আন্দোলনকে সমর্থন করে লেখার জন্যে ছয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন। 


ডাবরের এই রায়ে খুশী হয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তাকে নাইটহুড উপাদি দেয় এবং বম্বে বার অ্যাসোসিয়েশন তার সম্মানে ডিনারের আয়োজন করে। এই খবর জিন্নাহর চেম্বারে আসা মাত্রই তিনি ক্ষুরধার ভাষায় বার অ্যাসোসিয়েশনকে চিঠি লেখেন যে "the Bar should be ashamed to want to give a dinner to a judge who had obtained a knighthood by doing what the Government wanted and by sending a great patriot to jail." অর্থাৎ তিলকের মত দেশভক্তকে কারাদণ্ডাদেশ দেয়া আর সরকারের পদলেহন করে নাইটহুড পাওয়া ব্যক্তির সম্মানে ডিনার আয়োজন করার জন্যে বার অ্যাসোসিয়েশনের লজ্জা হওয়া উচিত।


লেখার শেষ করবো Evelyn Beatrice Hall নাম্নী এক লেখিকার, যিনি S.G. Tallentyre ছদ্মনামে লিখতেন, বিখ্যাত সেই উক্তি দিয়ে, "I do not agree with what you have to say, but I'll defend to the death your right to say it" মানে অপরের বক্তব্য আমার মনের মত নাও হতে পারে কিন্তু তার বক্তব্য রাখার অধিকারকে আমি কখনই অস্বীকার করতে পারিনা। বিচারালয় হোক বা প্রশাসন, তারা যদি ক্ষেত্রবিশেষে চুপ থাকে আর ক্ষেত্রবিশেষে মুখর হয়, তাহলে সেটা অন্যায়।

No comments:

Post a Comment