Thursday, December 16, 2021

বিজয় দিবস

সাল ১৯৭১। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান, বর্তমান বাংলাদেশে চলছে পাকিস্তানের অকথ্য অত্যাচার। জলস্রোতের মত ভারতে আসছে শরণার্থীরা। ভারতের অর্থনীতির উপর ক্রমশই বাড়ছে চাপ আর তার সাথে ভাঁজ বাড়ছে প্রধানমন্ত্রী, ইন্দিরা গান্ধীর কপালে। নতুন দিল্লীর সাউথ ব্লকে চলছে একের পর এক মিটিং - ফিন্যান্স, মিলিটারি, ইন্টেলিজেন্স, বিদেশ দপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের সাথে, উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত কথা বলে চলেছেন ইন্দিরা গান্ধী।


এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে, ৩০শে জানুয়ারি, শ্রীনগর থেকে জম্মু যাওয়ার পথে হাইজ্যাক করা হলো ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের 'গঙ্গা' (Fokker F-27) বিমান এবং হাইজ্যাকাররা, হাশিম কুরেশী ও তার ভাই আশরাফ কুরেশী, বিমানটিকে নিয়ে যায় লাহোরে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে 'গঙ্গা' ছিল ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের সবচেয়ে পুরনো যাত্রীবাহী বিমান এবং সেটাকে বাতিল হিসাবে ঘোষণা করার পর, এই ঘটনার কয়েকদিন আগেই পুনরায় সার্ভিসে ফেরত নেয়া হয়।


বিমানটি লাহোরে নিয়ে যাওয়ার পর, পাকিস্তানে হাইজ্যাকারদের রাজকীয় সম্মান প্রদর্শন করা হয়। তাদের সাথে দেখা করেন খোদ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, জুলফিকার আলি ভুট্টো। এরপর শুরু হয় দুই দেশের মধ্যে আলোচনা। অবশেষে, ১লা ফেব্রুয়ারি, অমৃতসর হয়ে, নিরাপদে ভারতে ফিরে আসেন বিমানকর্মী ও যাত্রী সমেত মোট ৩০ জন কিন্তু বিমানটিকে লাহোরে ধ্বংস করে দেয় হাইজ্যাকাররা। এই ঘটনায় সারা বিশ্বের কাছে পাকিস্তান হেয় হলেও পাকিস্তানের শাসকশ্রেণী এই ভেবেই খুশী ছিল যে ভারতকে ঝুঁকতে বাধ্য করা গেছে।


এই ঘটনার তিনমাসের মধ্যে, পাকিস্তানকে উগ্রপন্থীদের সাহায্যকারী দেশ হিসাবে চিহ্নিত করে, ভারতের বায়ুসীমায় নিষিদ্ধ করা হয় পাকিস্তানের বিমান। এরফলে, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের দূরত্ব মুহূর্তে বেড়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যেসব সামগ্রী সিভিল এয়ারলাইনসে পাঠানো হতো সেগুলিকে এবার তিনগুণ বেশী পথ ঘুরে আর বাড়তি জ্বালানী খরচ করতে বাধ্য হলো। এর ফলে দুর্বল হয়ে গেল পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বিমান যোগাযোগ। অসহায় হয়ে গেল পূর্ব পাকিস্তানে থাকা তাদের এয়ারফোর্স।


এতদিনে পাকিস্তান বুঝতে পারে যে হাইজ্যাকিং এর মাধ্যমে তাদের পুরো 'মুরগী' বানিয়েছে ভারতের গুপ্তচর সংস্থা, RAW (Research & Analytical Wing)। বাতিল এয়ারক্রাফট দিয়ে তাদের কিভাবে বোকা বানানো হয়েছে সেটা তারা এতদিনে বুঝতে পারে। যে কুরেশী ভাইদের তারা এতদিন হিরো বানিয়েছিল, তাদেরই এবার শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। একইসাথে ধরপাকর শুরু হয় লাহোর, শাহী কিলা মুজফফরাবাদের কাছে দোলাই ক্যাম্পে। গ্রেপ্তার করা হয় JKNLF এর কয়েকশো সদস্যকে। পরে, ৬ জন JKNLF সদস্যকে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সাথে সহযোগিতা করার অভিযোগে বিচার করা হয়। মজার কথা হলো এদের অধিকাংশই উভয় দেশের কাছে অপরাধমূলক কাজে যুক্ত ব্যক্তি।


প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী'র সুযোগ্য নেতৃত্বে RAW জানুয়ারি মাসে যে অপারেশন করেছিল তারই সুফল মেলে ডিসেম্বর মাসের যুদ্ধে। আজ সেই বিজয় দিবস। বাংলাদেশের সৃষ্টি পাকিস্তানকে এতটাই আহত করে যে পাকিস্তানের তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল, পাকিস্তান পিপলস পার্টির মুখপাত্র, ডেইলি মুশায়ত তাদের ১৮ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালের সম্পাদকীয়তে লেখে যে "Today the entire nation weeps tears of blood. Today the Indian Army has entered Decca. Today for the first time in 1000 years Hindus have won a victory over Muslims". ভারতবর্ষকে ত্রিখন্ডিত করে তৈরী হওয়া ইসলামিক পাকিস্তানকে, সৃষ্টির মাত্র ২৩ বছরের মধ্যে দ্বিখণ্ডিত করে, নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করার এই শুভ দিনে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, ভারতীয় সেনা এবং সবার চোখের আড়ালে কাজ করে যাওয়া ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা, RAW কে আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই।

Sunday, December 12, 2021

বামপন্থা

না, বামপন্থীদের নিয়ে আমার কোন ছুৎমার্গ নেই বরং আমি মনে করি যে দক্ষিণপন্থীদের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্যে বামপন্থীদের থাকার অবশ্যই প্রয়োজন আছে। এটা ভুলে যাওয়া চরম ভুল হবে যে বামপন্থার জন্ম হয়েছিল কালের নিয়মে, ক্ষমতাসীন দক্ষিণপন্থীদের শোষণমূলক নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অস্ত্র হিসাবে। তাই যতদিন দক্ষিণপন্থা থাকবে, সামাজিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যে, ততদিন বামপন্থাও বেঁচে থাকবে।


বামপন্থীদের নামকরণ নিয়ে নানারকম মত প্রচলিত আছে, যার মধ্যে, আইনসভাতে তাদের স্পিকারের বাম দিকে বসার উল্লেখও আছে কিন্তু আমার মনে হয় এটা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুতে দেয়ার মতো কারণ তারা আইনসভাতে বসার আগেই নিজেদের আলাদা পরিচয় প্রতিষ্ঠা করেছিল আর সেই কারণেই তারা নির্বাচিত হয়েছিল। আমার ধারণা অনুসারে, সমাজের অধিকাংশ মানুষের যেহেতু ডান হাত বেশী সক্ষম, বাম হাতি মানুষের সংখ্যা তুলনামূলক কম, তাই প্রথাগত ধারণা ও কাজের বাইরে আলাদা পরিচয় স্থাপন করার জন্যেই বামপন্থী পরিচয় তৈরী হয়েছে।


হ্যাঁ, এবার অনেকেই ভারতে সিপিএম, সিপিআই বা বিদেশের চেসেস্কু থেকে পল পটের উদাহরণ দিয়ে বামপন্থার খারাপ দিক তুলে ধরতে পারেন কিন্তু আমার কাছে এই খারাপ হওয়ার মূল কারণ হলো ক্ষমতা লাভ। যেকোন রাজনৈতিক দলের আদর্শকে দূষিত করে দেয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো তাদেরকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়া। বামপন্থা স্বভাবগতভাবে হলো ক্ষমতাসীনের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার অঙ্কুশ কিন্তু এই অঙ্কুশ যখন নিজেই ক্ষমতায় বসে যায় তখন তার ব্যবহার হয়ে যায় শূন্য। ফলে সেটাতে জং ধরতে বাধ্য। নকশালরা কখনও ক্ষমতায় বসেনি তাই তাদের আদর্শের প্রতি, আচরণের বিচ্যুতির কথা বলছিনা, এখনও অনেকে শ্রদ্ধাশীল। এমনকি SUCI এর মত একটা ছোট্ট সংগঠনের প্রতি তাদের যা ভরসা আছে সেটা ক্ষমতায় থেকে কলুষিত সিপিএমের প্রতি আর আসবেনা।


এই কারণেই আমি বামপন্থা আর কম্যুনিজমকে এক করে দেখিনা। বামপন্থা একটা শক্তি যেটার প্রয়োজন আছে। এবার ইলেকট্রিক বলতে কেউ যদি শুধু ইলেক্ট্রিক চেয়ার বোঝেন তাহলে আমি অসহায়।