Wednesday, March 30, 2022

মন্দিরে অহিন্দুর নাচে বাধা কতটা বৈধ?

কেরলের কম্যুনিস্ট সরকার নিয়ন্ত্রিত মন্দির কতৃপক্ষ অহিন্দু হওয়ার কারণে নৃত্যশিল্পী মানসিয়া দ্বারা মন্দিরে নাচ পরিবেশনে অনুমতি না দিলেও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ কিন্তু এক DNA-র কথা ভোলেনি। তাই তারা তাদের নিয়ন্ত্রিত কোচির পাভাক্কুলম মন্দিরে সেই মানসিয়া'কে নৃত্য পরিবেশনের আহ্বান জানিয়েছে। হুঁ হুঁ, একেই বলে অরাজনৈতিক হিন্দু সংগঠন। তবে খ্রিষ্টান হওয়ার কারণে, মানসিয়া'র মত, সৌম্যা সুকুমারণও বিখ্যাত কুদালমাণিক্যম মন্দিরে নাচের অনুমতি না পাওয়ায় তাকেও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ তাদের নিয়ন্ত্রিত মন্দিরে নাচ পরিবেশনের আমন্ত্রণ পেয়েছেন কিনা জানা নেই।


সোশ্যাল মিডিয়াতে যারা মানসিয়া'কে মন্দিরে নাচতে অনুমতি না দেয়ার সিদ্ধান্তে মন্দির কর্তৃপক্ষকে কাঠগড়ায় তুলছেন তাদের জানা উচিত যে সংবাদমাধ্যমে যখন এই অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছিল তখন স্পষ্ট জানানো হয়েছিল যে শিল্পীকে হিন্দু হতেই হবে। মানসিয়া সেটা দেখেও আবেদন করেন। এরপর কর্তৃপক্ষ তার সঙ্গে যোগাযোগ করে এটা স্পষ্ট করতে চান যে তার স্বামী যেহেতু হিন্দু, তিনিও কি হিন্দু মতাদর্শে বিশ্বাসী। উত্তরে মানসিয়া লিখিতভাবে জানান যে তিনি কোন ধর্মে বিশ্বাস করেননা। এরপরেও যারা মন্দির কর্তৃপক্ষের কল্লা চাইছেন তারা বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠানে যেতেই পারেন।


ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যকে মূলত চারটে ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, আদি পর্ব, যেখানে নাচ মানে ছিল ভাব প্রকাশের মাধ্যম। হরপ্পা বা মহেঞ্জোদারো হোক অথবা বেদ বা উপনিষদ এমনকি খ্রীস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর উদয়গিরি জৈন মন্দিরের দেয়ালেও এই মূদ্রা দেখা যায়। দ্বিতীয় পর্বের ব্যপ্তি মূলত খ্রীস্টপূর্ব নবম শতাব্দী থেকে দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত এবং এই পর্যায়েই নাচ, নিছক ভাব প্রকাশের মাধ্যম থেকে, ঈশ্বরের উপাসনায় পরিণত হয়। এই সময়েরই বিখ্যাত নিদর্শন হল সাঁচি, ভজ, অমরাবতী, নাগার্জুনকোন্ডা এবং ইলোরার গুহাচিত্র। এই সময়েই দেবদাসী প্রথার উৎপত্তি হয় যারা মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের আরাধনার সঙ্গে সমানতালে নৃত্য পরিবেশন করতেন। পনের থেকে ষোল প্রকারের কলা দ্বারা তারা বিগ্রহের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতেন। তৃতীয় কুলোতুঙ্গার রাজত্বকালে পুদুক্কোলতাই শিলালিপিতে এর বিবরণ আছে যা Marie Gaston তার Bharat Natyam: From Temple to Theatre বইতে উল্লেখ করেছেন।


তৃতীয় ভাগের বিস্তার প্রধানত খ্রীষ্টপূর্ব দশম শতক থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত। এই পর্যায়ে শাস্ত্রীয় নৃত্যে বিভিন্ন আঞ্চলিক প্রভাব প্রতিফলিত হয় এবং এই কালখন্ডেই শাস্ত্রীয় নৃত্য, শুধুমাত্র ঈশ্বরের উপাসনা থেকে একটা শিল্প এবং শিক্ষায় রূপান্তরিত হয়। চতুর্থ ভাগের সূত্রপাত হয় অষ্টাদশ শতাব্দী, অর্থাৎ ব্রিটিশ আক্রমণের পর থেকে। নাচের অনুষ্ঠানে যেহেতু জনসমাগম ঘটতো তাই সেটা শাসকের পক্ষে খুব একটা সুখকর ছিলনা। তাই ব্রিটিশ শিক্ষা শাস্ত্রীয় নৃত্যকে শিল্প হিসাবে মেনে নিতে অস্বীকার করলো এবং সেই শিক্ষায় শিক্ষিতরাও শাস্ত্রীয় নৃত্যকে কালিমালিপ্ত করতে শুরু করলো। এরই পরিণতিতে শাস্ত্রীয় নাচ ধীরে ধীরে জনসমক্ষ থেকে সরে মন্দির, ধনীদের ব্যক্তিগত গৃহ ও বেশ্যালয়ে আশ্রয় লাভ করলো।


মন্দির গঠনেও নাচের প্রভাব অপরিসীম। দ্রাবিড়ীয় মন্দির নির্মাণের যে মূল তিনটি শৈলী- লয়ন, গুহধারা এবং গুহরাজা - সেগুলো প্রাপ্ত হয় ঋষি ভরত রচিত, ৩৭টি অধ্যায় সম্বলিত, প্রাচীন গ্রন্থ নাট্যশাস্ত্র থেকে। নাট্যশাস্ত্র'র প্রথম ভাগে রস, দ্বিতীয় ভাগে সাহিত্য আর তৃতীয় ভাগে গঠনশৈলী (architecture) নিয়ে বিশদে লেখা আছে। মন্দিরের নাট্যমঞ্চ কেমন হবে সেটার ব্যখ্যা দেয়া মন্ডপারিধনম অধ্যায়ে। প্রমোদ কালে তার The Theatric Universe বইতে বলেছেন যে সেই নাট্যমঞ্চ তৈরী হতো নর্তকীর দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, দর্শকদের নয়। নর্তকীদের গুরুত্ব দেয়ার কারণ হল তারা নাচের মাধ্যমে নিজেদেরকে বিগ্রহের প্রতিমূর্তি হিসাবেই তুলে ধরতেন। গঠন অনুসারে নাট্যমঞ্চগুলি ছিল ৬৪ হস্ত মাপের ত্রস্র, ৩২ হস্ত মাপের চতুস্র এবং ৩২x৬৪ হস্ত মাপের বিকৃষ্ট। হস্ত বা মুষ্টি হল ভারতে দৈর্ঘ্য পরিমাপের এক প্রাচীন একক। এক হস্ত মানে মোটামুটি ১৮ ইঞ্চি বা ৪৫ সেন্টিমিটার। 


যাইহোক, মূল কথা হল যে ভারতনাট্যম ও মন্দির, একে অপরের সাথে অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবধ্য। এমনকি ভারতনাট্যম শব্দবন্ধটিও গঠিত হয়েছে নাচের চারটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় অনুসারে। ভা মানে ভাব বা আবেগ, রা মানে রাগ বা সুর ও বাদ্য, তা মানে তাল বা ছন্দ এবং নৃত্যম মানে নাচ। তাই নাট্যশাস্ত্র অনুযায়ী ভারতনাট্যম হল তাল ও বাদ্য সহযোগে নাচের দ্বারা আবেগ প্রকাশ। এক্ষেত্রে কেউ যদি সনাতন ধর্মের প্রতি আবেগই না রাখেন তাহলে তার নাচ অসম্পূর্ণ এবং ত্রুটিপূর্ণ। আর কে না জানে যে হিন্দুরা নিঁখুত জিনিস ব্যতীত কিছুই দেবতাকে নিবেদন করেন না।