Saturday, April 9, 2022

মা অন্নপূর্ণা পূজা

"আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে"- বাঙালীর চিরন্তন এই প্রত্যাশাই মা অন্নপূর্ণা'র কাছে প্রকাশিত হয়েছিল ঈশ্বরী পাটনী রূপে। কিন্তু সন্তানকে দুধে-ভাতে রাখার জন্যে শুধু প্রত্যাশাই যথেষ্ট নয়, সেটাকে রূপায়িত করার জন্যে যথেষ্ট প্রয়োগ ক্ষমতাও থাকা দরকার। প্রত্যাশা তো একজন ভিখিরিরও থাকে কিন্তু প্রয়োগ ক্ষমতা বিহীন তার সেই প্রত্যাশা অন্য কারুর সদিচ্ছার উপর নির্ভরশীল। তাই প্রত্যাশা পূরণের জন্যে প্রয়োগ ক্ষমতা আবশ্যিক।


১৯৪৬ সালের ১০ই অক্টোবর, এক কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার দিন, অধুনা বাংলাদেশের নোয়াখালীতে হিন্দুরা যখন লক্ষ্মী পূজার আয়োজনে ব্যস্ত, তখনই তাদের উপর নেমে এসেছিল জেহাদিদের করাল থাবা। যে সন্তানদের দুধে-ভাতে রাখার জন্যে বাঙালী পূজা করছিল, সেই সন্তানদেরই ধর্ষিত, মৃত দেহ ছুঁড়ে ফেলা হয় তাদের সামনে। বাঙালী মহিলাদের পরামর্শ দেয়া হয় ধর্ষণের জ্বালা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করার। অহিংসার মোড়কে তাদের প্রতিশোধস্পৃহা ধ্বংস করা হয়। সন্তানকে দুধে-ভাতে রাখার স্বপ্ন দেখা বাঙালী নিজেদের সর্বস্ব হারিয়ে, শুধু নিজেদের হিন্দু পরিচয়টুকু বাঁচানোর জন্যে, বেছে নেয় উদ্বাস্তু জীবন।


দিন বদলেছে, কিন্তু সময় বদলায়নি। আজও যখন কালিয়াচক, ধুলাগড়, বাদুড়িয়া, আসানসোল বা তেলেনিপাড়াতে সেই জেহাদি আক্রমণ হয়, তখনও সেই হিন্দুদেরই সংযম বজায় রাখার পরামর্শ দেয়া হয়। টিকিয়াপাড়াতে পুলিশকে লাথি মারা ব্যক্তির বাড়িতে পৌছে যায় রেশন আর তেলেনিপাড়ার কথা সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রকাশ করে দেয়ার 'অপরাধে' পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করে। সুদূর উত্তর প্রদেশের আখলাক কে নিয়ে সবাই ব্যথিত হলেও রায়গঞ্জের টোটোন দাস, বাদুড়িয়ার নিতাই দাস, অশোকনগরের মৌসুমি বিশ্বাস, খড়গপুরের রোহিত তাঁতীদের কথা আমাদের বলাই হয়না। দিল্লীর নির্ভয়াকান্ডে, ধর্ষণ করেও মহঃ আফরোজ ছাড়া পেয়ে যায় শুধুমাত্র তার ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে অথচ বাদুড়িয়ার শৌভিক নাবালক হওয়া সত্ত্বেও পুলিশ তাকে অনায়াসেই জুভেনাইল হোমের বদলে, জেলে ঢুকিয়ে দেয়।


তাই আজ শুধু "সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে" প্রার্থনাই যথেষ্ট নয়, সন্তানের সাথে যেন কোন বঞ্চনা না হয়, একইসাথে সেটা সুনিশ্চিত করাটাও প্রয়োজন। আর এই বঞ্চনার অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় পাশ হওয়া OBC আইন। যে আইন আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া ব্যক্তিদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার সহায়ক হতে পারতো, সেটাকেই, ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে ব্যবহার করা হয়েছে আর প্রকৃত দাবীদারদের অগ্রাহ্য করে, একটা বিশেষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ও চাকরিতে অন্যান্যদের তুলনায় বাড়তি সুবিধা দেয়া হয়েছে। লক্ষ্যটা একদম স্পষ্ট, বছরের পর বছর ধরে, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ও চাকরিতে একটা বিশেষ সম্প্রদায়ের লোকের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়ে এমন একটা শৃঙ্খল তৈরী করা যেটা দিয়ে পুরো প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।


আজ আপনি নাহয় নিজের সন্তানকে খাঁটি দুধের বদলে জল মেশানো দুধ দিয়েই ভাত খাওয়াচ্ছেন, কিন্তু এই পরিস্থিতির যদি পরিবর্তন না ঘটানো হয়, তাহলে আপনার পরের প্রজন্মের সেই জল মেশানো দুধটা কেনার সামর্থ থাকবে তো? পুরো সিস্টেমটাই যদি একটা বিশেষ সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, আপনি সেই প্রশাসনের থেকে সুবিচার পাবেন তো? নোয়াখালীর বাঙালীরা পেয়েছিল? কাশ্মীরি পন্ডিতরা পেয়েছিল? বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের হিন্দুরা পাচ্ছে তো?


এই কারণেই শুধু প্রত্যাশা যথেষ্ট নয়, সেটা পূরণ করার ক্ষমতাও থাকা দরকার। আজ আত্মদীপ সেই বিভেদমূলক OBC আইনের বিরুদ্ধে এগিয়ে এসে, যেটা আরও আগেই করা উচিত ছিল, কলকাতা হাইকোর্টে সেই আইনকে বাতিল করার আবেদন জানিয়েছে। কিন্তু এই লড়াইটা শুধু আত্মদীপ-এর নয়, পশ্চিমবঙ্গের সব বাঙালীর কারণ বনে যখন আগুন লাগে, সেই আগুন কোন ভেদাভেদ করেনা। তাই আজ মা অন্নপূর্ণা পূজার দিন, যখন মায়ের পুজো করবেন তখন শুধু নিজের পরিবারের ধন, সম্পদ, সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য চেয়েই থেমে যাবেননা, সেগুলিকে রক্ষা করার মত শক্তিও যেন আপনার থেকে, সেটাও প্রার্থনা করুন। নাহলে পূর্ববঙ্গের বাঙালীদের মত, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীদের উদ্বাস্তু হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।

সবাইকে মা অন্নপূর্ণা পূজার শুভেচ্ছা জানাই।

No comments:

Post a Comment