Thursday, April 7, 2022

সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ

মেকলে প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সেটাতে শিক্ষিতদের ধারণা যে বৈদেশিক আক্রমণের আগে ভারতবর্ষে কখনই ঐক্য ছিলনা। দেশ বলে কোন ধারণা ছিলনা। ভারত নেহাতই ছিল কতগুলো রাজ্যের সমষ্টি। ইসলামিক ও ব্রিটিশ শাসনই নাকি ভারতবর্ষকে প্রথম একটা সম্পূর্ণ দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছে। তাই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী অনায়াসেই বলতে পারেন যে "We are a nation in making"। অর্থাৎ, ভারতে জাতি বা জাতীয় সত্বা বলে কিছু নেই, সেটা নাকি সবেমাত্র তৈরী হচ্ছে।


১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হলেও সাদা চামড়ার ব্রিটিশদের থেকে ক্ষমতা গেল বাদামী চামড়ার নব্য সাহেবদের হাতে। তারপর থেকে ক্ষমতায় যারাই থেকেছে তারা সেই কলোনিয়াল মানসিকতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। তাদের ধারণা অনুসারে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত না হলে তারা প্রকৃত শিক্ষিত নয়। দেশের সাধারণ মানুষের মঙ্গল কিসে হবে সেটা নির্ধারণ করার যোগ্যতা ও অধিকার একমাত্র তাদেরই আছে। একইসাথে তাদের ধারণা যে সংখ্যালঘুরা (পড়ুন মুসলমানদের) যাই করুক, তাদের রক্ষা করার দায় হিন্দুদের।


কিন্তু এখানে মজার কথা হল যে ভারতে বসবাসকারী মুসলমানরা এই দেশে ইসলামিক আগ্রাসনের আগের গৌরবময় ইতিহাস সম্পর্কে গর্বিত হওয়া তো দূরের কথা, আগ্রহী পর্যন্ত নয়। পাল যুগ, গুপ্ত যুগ, সেন যুগ তাদের আগ্রহ জাগায় না। অজন্তার গুহাচিত্র বা দক্ষিণ ভারতের মন্দিরশৈলী নিয়ে তাদের গর্ব নেই। চেঙ্গিস খান, তুঘলক, ঘোড়ি বা মোঘলদের মত বিদেশী ঠগ, গুন্ডা, হানাদারদের নিয়ে তারা গর্বিত হয় কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে, দেশের সংস্কৃতিকে রক্ষাকারী শিবাজি, রানা প্রতাপ, বিজয়নগরের হরিহর ও বুক্কো, শশাঙ্ক কে নিয়ে তাদের গর্ব হয়না। একমাত্র সঙ্গীত ছাড়া ভারতের আর কোন কলা - সেটা নির্মাণ শিল্প হোক, রন্ধন শিল্প হোক বা সাহিত্য - সম্পর্কেই তাদের আগ্রহ ছিলনা। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তাদের আগ্রহের কারণ হল আরবী সংস্কৃতিতে সঙ্গীতের কোন স্থান ছিলনা এবং দ্বিতীয়ত বহু সঙ্গীতশিল্পীই ভয়ে বা রাজঅনুগ্রহ লাভের জন্যে ইসলামের মতাবলম্বী হয়েছিলেন। কিন্তু তারপরেও তারা আশা করে যে হিন্দুদের উচিত ভারতমাতা ও দেবী সরস্বতীর নগ্ন ছবি আঁকা ফিদা হুসেনের ছবি দেখে মুগ্ধ হওয়া, ইকবালের মত হিন্দু বিরোধীর রচনা নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়া বা শায়েরী ও গজল শুনে "ওয়াহ ওয়াহ" করা।


ভারতের রাজনৈতিক শাসকদের এই ক্লীবতা এবং হিন্দু ধর্মগুরুদের সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে নিস্পৃহতাই হিন্দুদের ধীরে ধীরে দুর্বল করে দিয়েছে। ইসলামিক নিগ্রহকে তারা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মত অমোঘ ও অপ্রতিরোধ্য ভেবে নিয়েছে। তাই ১৯৮২ সালে, NCERT রীতিমতো ঘোষণা করে ভারতের ইতিহাস পুনর্লেখনের নামে ইতিহাস থেকে ভারতের গৌরবময় ইতিহাসের কথা, বিশেষত গুপ্তযুগের কথা বিশদে বাদ দেয়ার জন্যে সার্কুলার জারি করলেও হিন্দুদের স্বাভিমানে সেটা আঘাত করেনা। অথচ বাস্তব হলো যে প্রত্যেকটা জাতিরই একটা স্বর্ণযুগ থাকে। চীনের ক্ষেত্রে মিঙ সাম্রাজ্য, জার্মানির বিসমার্ক, ইংল্যান্ডের এলিজাবেথের শাসনের মতই ভারতে গুপ্ত যুগ একটা স্বর্ণযুগ যখন প্রতিটা ক্ষেত্রে জাতির বিকাশ ঘটেছিল। একইভাবে, ১৯৮৯ সালে, তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার সার্কুলার দিয়ে ইতিহাস থেকে মুসলমান আক্রমণের বর্বরতার কথা মুছে দিতে চাইলেও হিন্দু সমাজ নীরব থেকে যায় কারণ দীর্ঘ পরিকল্পনার মাধ্যমে তার জাতীয় পরিচয়কেই মুছিয়ে দেয়া হয়েছে।


এটা অত্যন্ত প্রশংসনীয় যে আজ রাজনৈতিক পালাবদলের সাথে, কেন্দ্রে মোদী সরকার আসার পরে, দেশের সামাজিক পরিস্থিতির কিছুটা হলেও উন্নতি ঘটেছে। না, রাজনৈতিক দলের উপর নির্ভর করে বা প্রশাসনের উপর ভরসা করে হিন্দুরা নিজেদের হৃতগৌরব ফেরাতে পারবেনা কিন্তু প্রদীপ জ্বালার আগে অন্তত সলতে পাকানোর কাজটা শুরু হয়েছে। যোগ বা আয়ুর্বেদের মত আবিস্কারের জন্যে বিশ্ব আবার ভারতের কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজের হিন্দু পরিচয়কে accidental birth বলার বদলে আত্মপরিচয় নিয়ে গর্ব প্রকাশ করছেন। তবে এতেই সন্তুষ্টির কোন যায়গা নেই কারণ এখনও বহু অসঙ্গতি রয়ে গেছে যেগুলো হিন্দু সমাজের জন্যে মঙ্গলকর নয়। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সাথে সামাজিক ক্ষমতায়ন না হওয়া অবধি বিশ্রামের সুযোগ নেই।

No comments:

Post a Comment