Thursday, April 28, 2022

রাষ্ট্রীয় সম্মানের অন্যদিক

রাষ্ট্র প্রদত্ত যেকোন নাগরিক সম্মান আসলে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নীতির প্রতিফলন মাত্র। যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে তারা তাদের অনুগামী বা নির্বাচনে লাভের অঙ্ক কষেই প্রাপকদের তালিকা তৈরী করে। তাই পদ্ম সম্মান, ভারতরত্ন, দেশিকোত্তম, সাহিত্য অ্যাকাডেমি বা জাতীয় পুরস্কার নিয়ে আমি আর উচ্ছ্বসিত হতে পারিনা কারণ, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে, এগুলো আসলে আনুগত্যের পুরস্কার।


এই কারণেই কিশোর কুমার বা রাহুল দেব বর্মণ তাদের বিপরীত রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে কখনও পদ্ম সম্মান পাননি আবার দাউদের সাহায্যকারী হওয়া সত্ত্বেও ইউসুফ খান ওরফে দিলীপ কুমার বা শারদ পাওয়ার পদ্ম সম্মানে বিভূষিত হয়েছেন। বছর খানেক আগে যখন 'অ্যাওয়ার্ড ওয়াপসি' ট্রেন্ড হয়েছিল তখনও সেটার মূল প্রেরণা ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। এই কারণেই ২০১০ এ পদ্মশ্রী প্রাপকদের, যারমধ্যে রয়েছেন ওড়িশি নাচের অন্যতম কিংবদন্তি, অশীতিপর গুরু মায়াধর রাউত, সরকারের দেয়া বাসভবন ছাড়তে বাধ্য করতে পারেন।


হ্যাঁ, আমাদের পরিচিত বা একই বিষয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা কখনও এই সম্মানের জন্যে বিবেচিত হলে আমরা উৎফুল্ল হই, রাষ্ট্রপতি ভবনের জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান দেখে মুগ্ধ হই আর নিজেদের এই ভেবে আশ্বস্ত করি যে আমাদের কাজ অবশেষে সরকারি স্বীকৃতি পেল কিন্তু একটু ভেবে দেখুন তো সরকার মানে আসলে কি? সেটা কি নিছকই একটা রাজনৈতিক দলের বা তাদের মতাদর্শের প্রতিফলন নয়? প্রাচীনকালে যেভাবে একটা মেয়েকে ছোটবেলা থেকেই পরিমিত বিষ খাইয়ে তাকে বিষকন্যা করে তোলা হতো এখন সেই কাজ করে চলেছে লর্ড মেকলে প্রচলিত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। ছোটবেলা থেকেই আমাদের অবচেতনে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে যে সরকার, সংবিধান, গণতন্ত্র, আইন ব্যবস্থা ইত্যাদি অত্যন্ত পবিত্র ব্যাপার। এগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা অপরাধ, ক্ষেত্রবিশেষে দেশদ্রোহ।


কিন্তু ভেবে দেখুন এগুলো সবকটা রাজনৈতিক শাসনের অঙ্গ মাত্র। সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর। তথাকথিত পবিত্র সংবিধানকে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী হামেহাল বদলে নেয় শাসকদল। গণতন্ত্রের মহিমা স্পষ্ট হয়ে যায় যখন এক বোতল দেশী মদের বিনিময়ে ভোট নিশ্চিত হয়ে যায়। H.L. Wayland যথার্থই বলেছিলেন যে, "Universal suffrage without universal education will be a curse" মানে সর্বশিক্ষা ছাড়া সবার ভোটাধিকার মানে সেটা অভিশাপ। এখানে শিক্ষা মানে শুধু বিদ্যা নয়, চেতনাও জড়িত। এই চেতনার বৈষম্যের কারণেই ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির জন্যে আমেরিকার রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করতে হয় আর পেগাসাস বা নারদা বা তহেলকা'র পরেও আমরা নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান বজায় রাখি।


দেশের আইন ব্যবস্থাকেও আমরা অত্যন্ত পবিত্র বলে মানি কিন্তু কাজ করতে গিয়ে দেখেছি সেই সিস্টেমের মধ্যে কত ফাটল। অর্থের ভূমিকা ছাড়াও যশের প্রলোভন কিভাবে বিচারকে প্রভাবিত করে সেটা সামনে থেকে দেখেছি আর তাই দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি তার অবসরগ্রহণের চার মাসের মধ্যেই রাজ্যসভায় মনোনীত হলে আর অবাক হইনা। কিছু বিচারকের অবসরগ্রহণের পর বিভিন্ন কমিশনের প্রধান হয়,  জনগণের ট্যাক্সের টাকায়, পাঁচতারা জীবন যাপন প্রমাণ করে দেয় তাদের কর্মজীবনের নিরপেক্ষতা।


এইসব দেখার পর আর কোন 'রাষ্ট্রীয়' যা আদতে 'দলীয়' সম্মান আর প্রভাবিত করেনা। সেনাদের সম্মানও এই প্রভাব মুক্ত নয়। ল্যান্সনায়ক হেমরাজের সাথে হওয়া অন্যায়ের উদাহরণ দিয়ে ক্ষমতায় আসার আট বছর পরেও তার পরিবারের সাথে দেখা করেননা প্রধানমন্ত্রী অথচ বিনা আমন্ত্রণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে যেতে পারেন। শুধু হেমরাজ কেন, পাঠানকোট, উড়ি বা পুলবামা'র কোন শহীদের পরিবারের সাথেই দেখা করেননি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার কোন সদস্য অথচ ৪৪ রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের ঔরঙ্গজেব জঙ্গীদের আক্রমণে শহীদ হওয়া মাত্রই তার বাড়িতে পৌছে গিয়েছিলেন তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী, নির্মলা সীতারমণ সহ তদানীন্তন সেনাপ্রধান, বিপিন রাওয়াত। এরপরেও আপনারা যদি ভাবেন এটার মধ্যে রাজনীতি নেই, তবে তাই হোক। আমি এই ছেলেখেলাতে আর ভোলার ভুল করবনা।

No comments:

Post a Comment