Thursday, May 27, 2021

ডিজিটাল দ্বারপাল

ডিজিটাল পৃথিবীতে কোন কিছুই আর গোপন নয়। আপনার করা প্রতিটি বার্তালাপ (conversation), প্রতিটি বিনিময় (transaction) এর ছাপ থেকে যায় সারা জীবনের জন্যে। আপনি হয়তো Incognito অথবা VPN ব্যবহার করে নিজেকে নিরাপদ ভাবছেন কিন্তু ভুলে যাচ্ছেন যে ব্রাউজার এবং আপনার ব্যবহৃত কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনের ব্রাউজিং ইতিহাসে সেই তথ্যের প্রতিলিপি থেকেই যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আপনার বিনিময় করা তথ্যের নিরাপত্তার জন্যে আপনি বিশ্বাস করছেন গুগল, ফেসবুক, ট্যুইটার বা হোয়াটসঅ্যাপের মত কারিগরি দৈত্যদের (technical giants) দেয়া আশ্বাসবাণীর উপরে যে আপনার তথ্য পুরোপুরি encrypted। এবার এই encryption কতটা সত্যি আর কতটা নিরাপদ সেটা নিয়ে আপনি তো ছাড়, কোন সরকারেরও পুরোপুরি ধারণা নেই। এই কারিগরি দৈত্যদের মুখ্যালয়ে, যেখানে বিভিন্ন সার্ভারের মাধ্যমে বিনিময় বা সঞ্চিত হচ্ছে আপনার তথ্য, সেখানে প্রবেশাধিকার রয়েছে কেবলমাত্র বিশেষাধিকার প্রাপ্ত কিছু ব্যক্তির। ফলে, তাদের দেয়া আশ্বাসবাণীর কতটা ঠিক, সেটা বিচার করার ক্ষমতা নেই আমার বা আপনার।

এই পরিস্থিতিতে, ভারত সরকার বর্তমান IT আইনে কিছু পরিবর্তন করে, সোশ্যাল মিডিয়াকে, তাদের মাধ্যমে প্রচারিত তথ্যের বিষয়ে দায়িত্বশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। এটা অস্বীকার করার কোন যায়গা নেই যে আজ থেকে ১৫ বছর আগে চলা অর্কুট বা ইয়াহু মেসেঞ্জার ছিল মূলত ব্যক্তিগত আলাপচারিতার মাধ্যম। এমনকি প্রাথমিক অবস্থায় ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপের ব্যবহারও ছিল প্রধানত ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু বর্তমানে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারের এবং তার মাধ্যমে স্বার্থসিদ্ধির অন্যতম হাতিয়ার। দেশের বিভিন্ন যায়গায় গণপিটুনির ফলে যেসব মৃত্যু ঘটেছে সেগুলি ঘটানোর পিছনে ব্যবহৃত হয়েছে হোয়াটসঅ্যাপের মত অ্যাপ। তাই, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আইনের পরিবর্তনটাও জরুরী আর সেটা মাথায় রেখেই, পরিবর্তিত আইনে, সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রচারিত কোন বার্তার, যা দেশের একতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হতে পারে, দায় নিতে হবে সেই মিডিয়াকেও। প্রয়োজনে প্রশাসনকে জানাতে হবে যে সেই বার্তার উৎস কোথা থেকে হয়েছে। আর সেই কাজ করার জন্যেই কোম্পানিগুলোকে বলা হয়েছে একজন কমপ্লায়েন্স অফিসার (যিনি দেখবেন যে আইন ঠিকমত অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা), একজন নোডাল অফিসার (যিনি প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ রাখবেন) এবং একজন অভিযোগ সুরাহার অফিসার বা Grievance Redressal Officer (যার কাছে অভিযোগ জানানো যাবে) আর এদের তিনজনেরই ভারতের কোন ঠিকানা দিতে হবে যাতে অনির্দিষ্টকালের জন্যে উত্তরের অপেক্ষায় বসে না থাকতে হয়। আর একইসাথে, প্রতি মাসে, অভিযোগ প্রাপ্তি ও সেগুলির সুরাহার বিষয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করতে হবে।

এখানেই বড় কোম্পানিগুলোর ব্যথা হচ্ছে যে এতদিন তারা, encryption ও ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তার বাহানায় যে দায়িত্ব এড়িয়ে যেত এবার থেকে সেগুলির দায় তাদের নিতে হবে। গ্রাহকদের বিভিন্ন তথ্য, এমনকি তাদের বিনা অনুমতিতে নেয়া তথ্য বেচেও তারা যে বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করতো অথচ সেগুলির দায় তাদের ছিলনা, এবার সেই পরিস্থিতি বদলাতে যাচ্ছে। আপনার তথ্যের বিনা অনুমতিতে ব্যবহার কিভাবে হয় সেটা খুব সহজে বুঝতে ফ্লিপকার্ট বা অ্যামাজনে যেকোন একটা জিনিস নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করুন আর তারপর ফেসবুক খুলুন, দেখবেন সেই প্রোডাক্টের বিজ্ঞাপন আপনার টাইমলাইনে ভেসে উঠবে। অফ-ফেসবুক অ্যাক্টিভিটির মাধ্যমে ক্রমাগত এই গোয়েন্দাগিরি চালিয়েই যাচ্ছে বিভিন্ন অ্যাপ। এমনকি অ্যালেক্সা বা গুগল ডট-এর মত স্বর চালিত (voice driven) প্রযুক্তির যন্ত্রগুলি, আপনার অনুমতি ছাড়াই রেকর্ড করে নিচ্ছে আপনার পরিবারের আভ্যন্তরীণ আলোচনা।

এমতাবস্থায়, আমি ভারত সরকারের নতুন আইনকে অবশ্যই সমর্থন করি। ডিজিটাল দুনিয়া থেকে আজকে আর বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় কিন্তু সেখানে যখন থাকতেই হবে তখন সেই দুনিয়ার দ্বারপাল হিসাবে, সিলিকন ভ্যালির কোন অজ্ঞাত সার্ভারের বদলে আমি আমার নির্বাচিত সরকার ও প্রশাসনের উপরেই বেশী ভরসা রাখবো।

No comments:

Post a Comment