কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ চলাকালীন পাণ্ডবরা যে কয়টি সিদ্ধান্ত সমকালীন যুদ্ধনীতির বিরুদ্ধে
নিয়েছে, সেটি শিখণ্ডীকে সামনে রেখে ভীষ্মকে পরাস্ত করাই হোক বা দ্রোনাচার্যর কাছে যুধিষ্ঠিরকে
দিয়ে তাঁর ছেলে অশ্বথামার মিথ্যা মৃত্যুসংবাদ পাঠিয়ে তাঁকে অস্ত্রত্যাগ করতে বাধ্য
করাই হোক, সেটি নিরস্ত্র অবস্থায় কর্ণকে বধ করতে অর্জুনকে প্ররোচিত করাই হোক বা গদাযুদ্ধের
সময় দুর্যোধনের ঊরুতে আঘাত করার জন্যে ভীমকে ইঙ্গিত করাই হোক, সেই সবকটি সিদ্ধান্তর
পিছনেই শ্রীকৃষ্ণর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ; যাকে
যুগাবতার বলে মানা হয়, যিনি যুদ্ধ যাতে না হয় তার জন্যে আপ্রান চেস্টা করেছিলেন, তিনি
যুদ্ধক্ষেত্রে এরকম অনৈতিক সিদ্ধান্তগুলি কেন নিলেন?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে প্রতিটি ঘটনাকে বিক্ষিপ্তভাবে না দেখে, সম্পূর্ন্য
যুদ্ধের প্রেক্ষিতে বিচার করতে হবে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ছিল ধর্ম আর অধর্মের মধ্যে।
ন্যায় আর অন্যায়ের মধ্যে। সে যুদ্ধে পান্ডব এবং তাঁদের পক্ষে যারা লড়াই করেছিল তারা
ছিল ধর্মের অনুসারী অপরদিকে কৌরববাহিনী ছিল
অধর্মের প্রতীক। তাই ধর্মের শাষন প্রতিষ্ঠা করার জন্যে কৌরবশাসনের পরাজয় ছিল একান্ত
প্রয়োজনীয়। আর ভীষ্ম, দ্রোনাচার্য, কর্ণ বা দুর্যোধনের মত মহারথীরা বেঁচে থাকলে সেই
অভীষ্ট লক্ষ্য অধরাই থেকে যেত। তাই তাঁদের মৃত্যু ছিল লক্ষ্যপূরণের পূর্বশর্ত। ইংরেজীতে
একটা কথা আছে – End justifies the means। শ্রীকৃষ্ণ এই আপ্তবাক্যটিরই ব্যবহারিক রুপ
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন।
আজকের দিনে আমরা যারা শ্রীকৃষ্ণকে ভগবানরূপে পূজো করি তাদের মধ্যে কতজন শ্রীকৃষ্ণর
এই ব্যবহারিক জ্ঞ্যান নিজেদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করি? কেন আমরা
আজকের শাসকশ্রেণীর কর্মকে অবজ্ঞ্যা করে শুধু তাদের নামের কৌলিণ্যে মগ্ন রয়েছি? কারুর
ব্যক্তিত্ব বা পূর্বকর্মই যদি তাঁকে বিচার করার একমাত্র মাপকাঠি হত তাহলে শ্রীকৃষ্ণ
কেন পাণ্ডবদের যুদ্ধের নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে ভীষ্ম, দ্রোনাচার্য, কর্ণ বা দুর্যোধনের
মত মহারথীদের বধ করতে প্ররোচিত করলেন? এটাই ভারতের দুর্ভাগ্য যে ভারতবাসীরা শ্রীকৃষ্ণকে
ভগবান বলে পূজো করেছে, তাঁর নামে মন্দির বানিয়েছে কিন্তু নিজেদের
জীবনকে শ্রীকৃষ্ণর মত ব্যবহারিক জ্ঞ্যান দ্বারা চালিত করেনি।
আর তারই পরিণতিতে আজও তাঁরা অধর্মের শাসনের অধীন হয়ে নিজেদের নিয়তিকে দোষারোপ করে
চলেছে। বেদব্যাস বর্ণিত (রচিত নয়) মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ বারংবার কর্মের উপর গুরুত্ব
আরোপ করেছেন, ধর্মকে গতিশীল ও রাষ্ট্রমূখী করার আহ্বান জানিয়েছেন কিন্তু হায়, তাঁকে
ঈশ্বররূপে কল্পনা করতে ব্যস্ত আমরা শুধু তাঁর
পূজোই করে গেছি, তাঁর আহ্বানে সাড়া দেইনি।
No comments:
Post a Comment