Saturday, December 28, 2019

পঞ্চতন্ত্রের শিক্ষা ও বাঙালী

গতকাল নৈহাটিতে একটা মেলার উদ্বোধন করতে মমতা ব্যানার্জী এসেছিলেন আর উদ্বোধনী বক্তৃতায় তিনি বলেছেন যে পশ্চিমবঙ্গে তিনি CAA বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বলবৎ হতে দেবেন না। অর্থাৎ, যে আইনের ফলে, পূর্ব-পাকিস্তান বা বাংলাদেশে, সেদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী মানে মুসলমানদের কাছে অত্যাচারিত বাঙালীরা, ভারতে এসে, নির্বিঘ্নে এদেশের নাগরিকত্ব লাভ করে, দুশ্চিন্তাহীন জীবনযাপন করতে পারেন, সেই আইন নাকি তিনি এই রাজ্যে চালু করতে দেবেন না।

সংবিধান অনুসারে, তাঁর এই অধিকার আছে কিনা সেই প্রশ্নে আপাতত যাচ্ছিনা কারণ সেটা জটিল আইনি বিষয়, তবে তিনি যেই রাস্তা ধরে নৈহাটি এসেছিলেন, আজ সেই কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে অফিস যাতায়াতের সময়, বিভিন্ন যায়গায় পার্টি থেকে লাগানো পোস্টার দেখলাম যেখানে লেখা আছে No CAA, No NRC। মজার কথা হল যে অনেক জায়গাতেই এইসব পোস্টারের নীচে যে নামগুলি লেখা আছে সেগুলি বাঙালীদের। আমার চোখে অন্তত একটাও মুসলমানের নাম পড়লনা।

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে, এদেশের নাগরিকত্ব প্রাপ্তির জন্যে শুধু হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, খ্রিস্টান আর পারসিক শরণার্থীদের নাম বিবেচনায় হওয়ায় আর মুসলমানদের উল্লেখ না থাকার ফলে, মমতা ব্যানার্জী তাঁর রাজনৈতিক স্বার্থে সোচ্চার হতেই পারেন কিন্তু নিজেদের শিক্ষিত ও সুবিবেচক হিসাবে দাবী করা বাঙালীরা তাঁর এই প্ররোচনায় কিভাবে পা দিতে পারেন, সেটা বুঝতে আমি অক্ষম। এই প্রসঙ্গে পঞ্চতন্ত্রের একটা গল্প মনে পড়ে গেল।


একদিন একটা ধূর্ত শিয়াল একটা কুয়োর মধ্যে পরে গেলো। শিয়ালটা কুয়ো থেকে বার হবার জন্য নানা চেষ্টা করেও বিফল হয়ে, একটু ধীরস্থির হয়ে চিন্তা করতে লাগলো। হঠাৎ তার নজরে পড়লো একটা বড়ো ছাগল,তার বিশাল দুটো শিং,ছাগলটা কুয়োর দিকে উঁকি মেরে দেখছে আর এদিক ওদিক দেখছে। শেষে ছাগলটা শিয়ালকে জিজ্ঞাসা করলো, "আরে শিয়াল ভায়া, তুমি এতো বুদ্ধিমান হয়ে কিভাবে কুয়োতে পড়লে?"


ধূর্ত শিয়াল বুঝলো যে এই সুযোগ, সে বললো "ওহে ছাগল আমার, তুমি সত্যিই ছাগল নাহলে এটাও বুঝলেনা যে আমি কেন কুয়োতে নামলাম!"  ছাগল অবাক হয়ে বললো, "না শিয়াল ভাই, আমার বুদ্ধিতে কুলোচ্ছেনা, আমি কিছুতেই বুজতে পারছিনা যে তুমি কুয়োতে নামলে কেন আর নামলেই যখন তখন এই কুয়ো থেকে বার হবে কিভাবে?" ছাগলের কথাটা শিয়াল একটু হাসলো এবং বললো যে "আমিতো ভালোই লাফাতে পারি তা নিশ্চয় তুমি জানো ,তাই এক লাফে যখন খুশি বের হয়ে যাব। তবে কি জানো, আমি তো এত তাড়াতাড়ি বের হতে চাই না। আমি মনস্থির করেছি যে এখানেই থাকবো।" শিয়ালের কথা শুনে ছাগল অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, "কেন ভাই তুমি কুয়োর মধ্যেই থাকতে চাও কেন, কি আছে এমন কুয়োতে?" এবার শিয়াল চালাকি করে বললো যে "হে আমার বোন তোমাকেই কেবল এই গোপন কথাটি বলছি, তুমি কাউকে বলনা কিন্তু"। ছাগল বললো, "না না আমি এই তিন সত্যি করে বলছি যে আমি কাউকে বলবোনা, তুমি গোপন কথাটি আমায় বলো"। তখন শিয়াল বললো দেখো কাউকে বলবেনা কিন্তু -তুমি তো জানোনা ,আর জানবেই বা কেমন করে তুমি তো আর খাওনি এই কুয়োর জল - এই কুয়োর জল একবার যে খাবে সেই বুঝবে যে কি মাহাত্ম্য এই জলের। আহা, কি সুস্বাদু এই জল, যেমন এর স্বাদ তেমন এর গুণ। একবার যে খাবে সেই পরম তৃপ্তি লাভ করবে। এই জল খেলে অন্য্ কিছুই খাবার প্রয়োজন হয়না। কি সুস্বাদু ,কি পুষ্টিগুণ। প্রাণ মন তৃপ্তিতে ভরে গেল। সেই কারণেই আমি মনস্থ করেছি যে আর আমি বাইরে যাবনা, বাইরে দিন রাত কত কষ্ট করতে হয় এই পেট টুকু ভরবার জন্য। সারা রাত এদিক সেদিক ঘুড়ে বেড়াতে হয় একটু খাবার জোগাড় করতে! তাও রোজ যোগাড় করতে পারিনা। তার উপরে নানা ভাবে প্রাণের ভয় তো আছেই। এখানে তো একদম নিশ্চিন্ত, কোন ভয়ও নাই। শুধু খাও আর ঘুমাও ,আহঃ কি সুস্বাদু এই জল! কিন্তু তোমাকে বলে আর কি হবে তুমি তো আর খাওনি এই জল। খাবেই বা কি করে তুমিতো আর লাফ দিতে পারোনা, তাই নামবেই বা কি করে!

শিয়ালের চালাকি না বুঝে নিজের বীরত্ব দেখাতে ছাগল লাফ দিয়ে কুয়োর ভেতরে লাফিয়ে পড়লো। ধূর্ত শিয়াল তো এটাই চাইছিলো। ছাগল লাফিয়ে নামতেই শিয়াল ছাগলের শিং-র উপরে চড়ে, একলাফে কুয়োর বাইরে বেরিয়ে গেল আর ছাগল নিজের বুদ্ধির দোষে কুয়োর ভেতরে পরে রইলো।

উপরের গল্পে শিয়ালের যায়গায় মুসলমানদের আর ছাগলের যায়গায় হিন্দুদের বসিয়ে দিন, তাহলেই বাস্তব ছবিটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। মানে, ১৯৪৭ সালে মুসলমানরা, ভারতকে ভেঙে, নিজেদের জন্যে আলাদা দুটি পেল, সেই দেশদুটিতে অমুসলিমদের উপর অত্যাচার করে তাদের দেশ ছাড়া হতে বাধ্য করলো অথচ দিদির দাবী যে এরপরেও তারা সেই দেশ থেকে ভারতে আসলে, তাদেরকেও এই দেশের নাগরিকত্ব দিতে হবে, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় চলা সমস্ত সুযোগসুবিধা দিতে হবে, এমনকি অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীদের বঞ্চিত করে, তাদেরকে OBC-A সংরক্ষণের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে সুযোগ দিতে হবে। মমতা ব্যানার্জী নাহয় ভোটের স্বার্থে দুধেল গাইদের লাথি খেতে সম্মত হতে পারেন কিন্তু তাঁর দলের বাঙালী সমর্থকেরা কি এতটাই দলদাস হয়ে গেছেন যে নিজেদের বঞ্চনার মধ্যেই সুখ উপভোগ করছেন? 

আজ নাগরিকত্ব আইনের ফলে, মুসলমান অনুপ্রবেশকারীরা, গল্পের সেই শিয়ালের মত, উদ্ধারের রাস্তা খুঁজছে। তারা খুব ভাল করে জানে যে সেই ছাগলের মত হিন্দুদের যদি তারা কুয়োতে নামাতে না পারে তাহলে তাদের উদ্ধার নেই। কিন্তু পঞ্চতন্ত্র পড়া শিক্ষিত বাঙালী যদি তাদের এই ফাঁদে পা দেয়, তাহলে দোষ কার? নিজেদের দেশের বিভাজন মেনে, পার্শ্ববর্তী দেশে তাড়া খেয়ে উদ্বাস্তু জীবন দেখার পরে, দিনে দিনে কর্মসংস্থানের সুযোগ সঙ্কুচিত হওয়ার পরেও যদি তারা এই আইনের কঠোরভাবে বলবৎ করার দাবীতে সোচ্চার না হয়, তাহলে জনসংখ্যার ভারসাম্যের হিসাবে তাদের পুনরায় উদ্বাস্তু হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র।      

No comments:

Post a Comment