স্থান - আসানসোল। কাল - ২০১৪এর নির্বাচনী প্রচার। পাত্র - ভারতীয় জনতা পার্টীর প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদী।
"মিত্রো...আপনাদের আশীর্বাদ নিয়ে যদি কেন্দ্রে ভারতীয় জনতা পার্টীর নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয় তাহলে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে এদেশে এসে বসবাসকারী সবাইকে আমরা সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দেবো।"
বক্তৃতা শেষ হতে না হতেই সারা রাজ্য তথা দেশজুড়ে বিতর্কের ঝড় উঠে গেল। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলিও মোদীর এই বক্তব্যকে ভিত্তি করে ঘোলাজলে মাছ ধরতে নেমে পরলো। ধর্মীয় তথা সাংস্কৃতিক কারনে বাংলাদেশে অত্যাচারিত হয়ে নিজেদের নিরাপত্তা তথা অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে এদেশে আশ্রিত হিন্দুরাও মোদীর কথায় প্রমাদ গুনলো।
চতুর রাজনৈতিক মোদী বুঝলেন যে চালে কিছুটা ভুল হয়ে গেছে। মুসলমানদের ভোট যে তিনি কোনদিনই পাবেন না সেটা তিনিও বোঝেন আর তাই বক্তব্যর পর হিন্দুরাও দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পরেছে। তাই বারাসাতে, নিজের পরবর্তী জনসভায়, তিনি তার আগের বক্তৃতার ব্যাখ্যা করে বললেন যে তিনি সেইসব লোকেদের তাড়ানোর কথা বলেননি যারা বাংলাদেশে নিরাপদে দুর্গাপূজা করতে না পেরে এই দেশে এসেছে। অর্থাৎ সরকার গঠন করলে তিনি যে খালি মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের এই দেশ থেকে তাড়াবেন, হিন্দু শরণার্থীদের নয় এই আশ্বাস তিনি দিলেন। আর এর ফলও মিললো হাতেনাতে। জেহাদী আক্রমনে জর্জরিত পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির একধাক্কায় দশ শতাংশেরও বেশী বেড়ে গেল। আর শুধু পশ্চিমবঙ্গ কেন, এই মেরুকরণের ফলে সারা দেশেই বিজেপির ঢেউ উঠে গেল আর পরিনামে এনডিএ-র জন্যে ২৭২+ এর প্রত্যাশী বিজেপি একাই ২৮২ টি আসন জিতে গেল।
জেহাদি সন্ত্রাস থেকে মুক্ত হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ভোট দেয়া হিন্দুরা নতুন সরকার গঠন হওয়ার কিছুদিন পরেই জানতে পারলো যে ভারতে বসবাসকারী মুসলমানরা নাকি আদতে দেশপ্রেমীক,তারা নাকি এই দেশের জন্যে জীবন পর্যন্ত দিতে পারে আর সেটা জানালেন নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, নরেন্দ্র মোদী। যদিও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ঘেঁটে কতজন মুসলমান দেশের জন্যে ফাঁসিকাঠে প্রান দিয়েছে সেই তথ্য জানাবার কোন দায় তার ছিলনা।
হিন্দুরা মোদীর বক্তৃতা শুনে যে স্বপ্ন দেখে ভোট দিয়েছিল - সেটা রামমন্দির নির্মান হোক বা নেতাজীর অন্তর্ধান রহস্য প্রকাশ - বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেই স্বপ্নগুলির কিছুকে 'জুমলা' (নির্বাচনী ধাপ্পাবাজি) বলে ঝেড়ে ফেলা হল আর বাকিগুলির জন্যে প্রয়োজনীয় সাংসদ না থাকার অজুহাত দিয়ে দেয়া হল। ভক্তদের জগঝম্পের মাঝে এই প্রশ্ন উঠতেই দেয়া হলনা যে স্বপ্ন দেখানোর সময় তিনি যে সংখ্যার দাবী করেছিলেন হিন্দুরা তার থেকে অনেক বেশী সংখ্যাই তাকে দিয়েছে।
ভোটের সময় যে মোদী দাবী করেছিলেন যে বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দু শরণার্থীদের তিনি এই দেশের নাগরিকত্ব দেবেন আর মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের ঘাড়ধাক্কা দিয়ে ওদেশে ফেরত পাঠাবেন সেই মোদী আজ আসামে NRC তৈরির অছিলায় বাঙালী হিন্দুদের এই দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা প্রায় চুড়ান্ত করে ফেলেছে। ওদেশ থেকে নিরাপত্তার স্বার্থে এদেশে এসে আশ্রয় নেয়া হিন্দুদের Push back- এর নামে বিএসএফ-কে দিয়ে গুলি করে মেরে ফেলতেও কুণ্ঠিত নয় মোদী সরকার। আজ যা আসামে শুরু হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে সেটা শুরু হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। এক সারদার জুজু দেখিয়ে, দিদির আগেকার আপত্তিকে উড়িয়ে যদি খোদ তাকে পাশে বসিয়েই ভারতের অতিরিক্ত ১০,০০০ একর জমি বাংলাদেশকে দিয়ে দেয়া যায় তাহলে রোসভ্যালী বা ভাইপোকে দেখিয়ে এই রাজ্য থেকে হিন্দু খেদানোও খুব একটা কঠিন কাজ হবে বলে মনে হয়না। হাজার হোক, এই দেশের উপর "দেশপ্রেমিকদের" মত অধিকার তো আর অন্য কারুরই নেই, তাই না?
No comments:
Post a Comment