Monday, May 4, 2020

ইতিহাসের শিক্ষা

বেশ কিছুদিন আগে, নেটফ্লিক্সে মোসাদের উপর একটা তথ্যচিত্র দেখেছিলাম যেখানে মোসাদের কয়েকজন প্রাক্তন অধিকর্তার সাক্ষাৎকার দেখানো হয়েছিল। সেখানে একজন বলেছিলেন যে, মুসলিম সমাজের বিশেষত্ব হচ্ছে যে তারা ইতিহাসকে মনে রাখে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সেই ইতিহাস বয়ে চলে। উদাহরণ স্বরূপ তিনি বলেন, আরব, ইরান সহ অন্যান্য ইসলামিক দেশে কাজ করতে গিয়ে তিনি দেখেছেন যে তিনি হয়তো কোন গ্রামে গিয়ে কোনও ব্যক্তির বাড়ির খোঁজ করলেন, গ্রামের লোকেরা তার খোঁজ দেবে এই বলে যে "ঐ গদ্দারের পরিবার" বা "ঐ চোরের বাড়ি"? মজার কথা হল যে ঐ বাড়ির সাত পুরুষেও কেউ হয়তো গদ্দারি বা চুরি করেনি, কিন্তু তাও সেটা গদ্দার বা চোরের পরিবার কারণ খোঁজ নিলে দেখা যাবে যে ঐ পরিবারের অষ্টম পুরুষ হয়তো এরকম কিছু করেছিল আর পুরো গ্রাম সেটা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মনে রেখেছে।

একই কথা ইহুদিদের জন্যেও প্রযোজ্য। প্রায় দু'হাজার বছর নিজেদের পিতৃভূমি থেকে বিতাড়িত থাকার পরেও তারা সেটা পুনরুদ্ধার করতে পেরেছিল কারণ তারা ইতিহাসকে নিজেদের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে, প্রতিটা নববর্ষের দিন তারা প্রার্থনা করেছে যে পরের নববর্ষ তারা জেরুজালেমে পালন করবে। আর এরই পরিণতিতে, বিভিন্ন প্রতিকূলতা অতিক্রম করে, পুনরুদ্ধার করে তাদের দেশ, ইজরায়েল যা আজ আর্থিক ও সামরিক শক্তিতে বহু প্রাচীন রাষ্ট্রকেই পিছনে ফেলে দিয়েছে।

উল্টোদিকে বাঙালীদের দেখুন, মাত্র সাত দশকের মধ্যেই তারা দেশ কেন টুকরো হয়েছিল সেটা ভুলে গেছে। দেশভাগের সময় তাদের পরিবারের উপর হওয়া অবর্ণনীয় অত্যাচারের কথা ভুলে গেছে। ১৯৪৬ এ খোদ কলকাতার বুকে, সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে হওয়া হিন্দু গণহত্যার কথা ভুলে গেছে। নোয়াখালী গণহত্যার কথাও ভুলে গেছে। বাংলার ক'জন প্রখ্যাত সাহিত্যিক বা চিত্রপরিচালক দেশভাগ, গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং বা নোয়াখালী নিয়ে বই লিখেছেন বা সিনেমা তৈরী করেছেন সেটা বলতে পারবেন? সত্যজিৎ থেকে সৃজিৎ, সুনীল থেকে শীর্ষেন্দু - এদের কারুর কাছেই এই উপমহাদেশের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা কোনও সৃষ্টির বিষয় হলনা কেন? আর খুচখাচ যে'কটা সিনেমা বা সাহিত্য রচিত হয়েছে তাতেও  সেকুলারিজমের নামে বিকৃতি ভরা হয়েছে যেখানে হাইলাইট করা হয়েছে একজন 'ভাল মুসলমান' কিভাবে একটা হিন্দু পরিবারকে রক্ষা করেছে আর প্রোজেক্ট করা হয়েছে যে সেটাই প্রকৃত ইসলাম।

আর আমরাও দিনের পর দিন ধরে এই জঞ্জালগুলোই গিলেছি আর নিজেদের সান্ত্বনা দিয়েছি যে এটাই হয়তো সত্যি, নিজেদের পরিবারের সাথে যেটা হয়েছে, সেটাই হয়তো ব্যতিক্রম। ক্যানিং ব্যাতিক্রম, কালিয়াচক ব্যতিক্রম, ধুলাগড় ব্যাতিক্রম, তেহট্ট ব্যাতিক্রম, বাদুড়িয়া ব্যতিক্রম, জামুড়িয়া ব্যতিক্রম, কাংলাপাহারি ব্যতিক্রম, উলুবেড়িয়া ব্যতিক্রম, টিকিয়াপাড়া ব্যতিক্রম, সবই ব্যতিক্রম যতক্ষণ না নিজের সাথে ঘটছে। এই প্রসঙ্গে বিখ্যাত সাহিত্যিক হিমাদ্রী কিশোর বাবুর সাথে আলোচনায় উনি বলেছিলেন যে লেখকরা লেখেননা কারণ প্রকাশক ছাপবেনা আর প্রকাশক ছাপবেনা কারণ পাঠক-পাঠিকারা "খাবে না"। কথাটা যে কতবড় সত্যি সেটা তসলিমা নাসরিনের সাড়া জাগানো 'লজ্জা' বইটার ইতিহাস ফলো করলেই বুঝবেন। বাবরী মসজিদ ধ্বংসের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর হওয়া অত্যাচারের প্রেক্ষিতে লেখা বইটার চোরা এডিশন পশ্চিমবঙ্গে লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে। কিন্তু সেটা মূলত হয়েছে বইটা সেদেশে নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে। তাই এদেশে আনন্দ পাবলিশার্স যখন আইনত সেই বই বিক্রি করলো, সেটা পাঠক-পাঠিকাদের সেরকম নাড়া দিলনা। একই লেখিকার, 'লজ্জা'র থেকেও বেশী মর্মস্পর্শী রচনা ছিল 'ফেরা', জানিনা পশ্চিমবঙ্গের পাঠককূলের কতজন সেই বইটার নামটাও শুনেছেন।

এমতাবস্থায়, দেশের রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা যদি তোষণের প্রতিযোগিতায় নামেন তাহলে দোষটা কার, তাদের না আমাদের? নেতা-নেত্রীরা তো সমাজ সংস্কারক নয় যে তারা বিবেক অনুযায়ী চলবেন, তাদের একমাত্র কাজ হলো সমাজের বর্তমান পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করে, নিজেদের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখা। এখানে বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ আর সেটা বুঝতে হলে মমতা ব্যানার্জীর হিজাব পরা ছবি থেকে রামনবমী পালনের উত্তরণ দেখুন, স্পষ্ট হয়ে যাবে। দিনের শেষে, একটা সমাজ ততটাই যোগ্য নেতা বা নেত্রী পায় যতটা তার নিজের যোগ্যতা। আপনি যদি ব্যতিক্রমের গল্পে ভুলে, সত্যকে অস্বীকার করেন তাহলে আপনাকেও "কয়েকজন ব্যক্তির ভয় বা রাগের কারণে করা কাজের জন্যে, গোটা সমাজকে দায়ী করা উচিত নয়" ধরণের উপদেশ বা পুলিশকে আক্রমণকারী পরিবারের দায়ভার পুলিশকেই বহন করে চলার মত ঘটনা মেনে নিতেই হবে।

1 comment: