Tuesday, March 17, 2020

কার্সিয়ঙের অভিজ্ঞতা


ভুটান ভ্রমণ আচমকা বাতিল হয়ে যাওয়ার পরে, শেষ মূহুর্তে পুরো পরিকল্পনাই ঢেলে সাজাতে হয়। কালিম্পং যেহেতু আগেই দেখা ছিল তাই এবার দার্জিলিঙে তিন রাত আর কার্সিয়ঙে এক রাত কাটানোর পরিকল্পনা করি। হাতে যেহেতু সময় একেবারেই ছিলনা, তাই গাড়িতে ফিরতে ফিরতে হোটেল বুকিং করি। দার্জিলিঙে তিন রাত কাটানোর জন্যে, Goibibo মারফৎ বুক করি হোটেল সেন্ট্রাল হেরিটেজ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা এবং কার্সিয়ঙে এক রাতের জন্যে, Oyo সূত্রে বুক করি হোটেল #মহিপাল_রিজেন্সি
৬ই মার্চ থেকে তিন রাত দার্জিলিঙে কাটানোর পরে, ৯ই মার্চ দার্জিলিঙ থেকে কার্সিয়ঙ পৌছাই বেলা আড়াইটে নাগাদ। হোটেলে চেক-ইন করতে গেলে ম্যানেজার জানান যে ঘর তখনও পরিস্কার হয়নি, অপেক্ষা করতে হবে। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে জানতে চাওয়াতেই ম্যানেজার হঠাৎই ক্ষেপে ওঠেন এবং বলেন যে Oyo তাদের টাকা ঠিকমত দিচ্ছেনা, তাই তাদের গ্রাহকদের দায় হোটেলের নয়। Oyo যখন তাদের টাকা দিচ্ছেনা, তাহলে তাদের হোটেলের নাম কেন Oyo-র তালিকায় রয়েছে, এই কথা বলতেই ম্যানেজার রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে যান এবং পরিস্কার বলে দেন যে তিনি আমাকে হোটেলে ঘর দেবেন না, আমি যা পারি করে নিতে পারি।
আমি ছাপোষা মধ্যবিত্ত, সাথে পরিবারও রয়েছে, তাই কিই বা করতে পারি? তাই ম্যানেজারকে সেটাই জানালাম যে, "বেশ, তাহলে তাই করি"। এতে ম্যানেজার তিড়িং করে লাফিয়ে ওঠেন আর বলেন, "কি করবেন, Oyo তে কমপ্লেন করবেন তো? করুন গিয়ে, কিচ্ছু এসে যায়না"। আমি আইন মেনে চলা নাগরিক, তাই ম্যানেজারকে জানালাম যে Oyo তে অবশ্যই করবো তবে তার আগে স্থানীয় থানায় একটা অভিযোগ জানাবো। এই শুনে ম্যানেজারের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং বলেন যে "পুলিশ? ওহ তো মেরে পাসই হ্যায়"! বলে তিনি কাউকে ডাকতে বলেন এবং ডাক শুনে, উপরের তলা থেকে পুলিশের এক কর্মচারী নেমে আসেন। ভদ্রলোকের মুখ থেকে তখনও মদের গন্ধ যায়নি। বুঝলাম যে দোলের দিনে তিনি এই হোটেলে একটু নিভৃতে আসবাসিক্ত হতে এসেছিলেন।
পুলিশ কর্মচারী এসে প্রথমে জানান যে "এখানে এরকমই নিয়ম। তাই আমাদের অপেক্ষা করা উচিত"। সেটা কতক্ষণ জানতে চাওয়ায় তিনি আর উত্তর দিতে পারেননা তবে ব্যাপারটা মিটিয়ে নিতে বলেন। আমি ভদ্রলোকের নাম জানতে চাই কিন্তু তিনি নিজের নাম জানিয়ে উল্টে কেন জানতে চাই সেই প্রতিপ্রশ্ন করেন। আগেই বলেছি যে আমি আইন মেনে চলা নাগরিক, তাই খোদ আইনের প্রতিনিধি (মাতাল হলেও, প্রতিনিধি তো) প্রশ্ন করলে নিরুত্তর থাকাটা শ্রেয় নয়। অতএব জানাতেই হল যে আমি ওনার কার্যকলাপ নিয়ে, উত্তরবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক পুলিশ অধিকর্তার কাছে অভিযোগ জানাবো।
অধিকর্তার নামটা যেন একটা ম্যাজিক ওয়ার্ড। নাম শুনেই সেই পুলিশ কর্মচারী চুপচাপ নীচে নেমে গেলেন আর ম্যানেজারটিও ফোনে হোটেলের মালিক, জনৈক সুরজ বাবুকে ধরলেন। কয়েক সেকেন্ড পর ম্যানেজার সেই ফোন আমাকে হস্তান্তরিত করলেন এবং ফোনের অপর প্রান্তে সুরজ বাবু ম্যানেজারের এরকম আচরণের জন্যে ক্ষমা চাইলেন এবং সব ভুলে হোটেলে থাকার জন্যে বারবার অনুরোধ করলেন। কিন্তু ঐ হোটেলে থাকার কোন ইচ্ছা আমার আর ছিলনা, তাই সুরজ বাবু ও ম্যানেজার বারবার ক্ষমা চাইলেও, আমি ক্ষমা করতে প্রস্তুত ছিলামনা। হোটেল থেকে বেড়িয়ে Oyo তেও পুরো ঘটনা জানাই এবং টাকা ফেরত দিতে বলি।
হোটেল থেকে বেড়িয়ে, ডাউনহিল ঘুরতে যাই এবং সেখান থেকে নামার পথে, যেখানে ইন্টারনেট কানেকশন পাই, Goibibo দিয়েই #মেরী_বিলাস নামে আরেকটা হোটেল বুক করি। এই নতুন হোটেলটা শহরের একটু বাইরের দিকে এবং মালিক, আদিত্য সাহু, নিপাট ভদ্রলোক। অবশ্য লোক বলাটা হয়তো ঠিক হলনা কারণ ওনার বয়স এখনও মধ্য তিরিশের কোঠায়। এই হোটেলে এসে উত্তরবঙ্গের সেই পুলিশ অধিকর্তাকে ফোন করি এবং তিনি বিষয়টা দার্জিলিঙের জেলা পুলিশের এক অধিকারীকে জানাতে বলেন। অতঃপর জেলা পুলিশের সেই অধিকারীর নম্বর যোগার করে, তাকে সম্পূর্ণ বিষয়টা জানাই। তিনি সব শুনে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন।
পরদিন সকালে একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসে। ফোন ধরে অপর প্রান্তে পাই কার্সিয়ঙ থানার আইসি ভদ্রলোক কে। তিনি ফোন ধরেই, তাঁর এলাকায় এরকম ঘটনা ঘটেছে বলে আন্তরিক দুঃখপ্রকাশ করেন এবং সব ঘটনা শুনে, উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। ১১ই মার্চ ফেরার প্রতীক্ষায় যখন বাগডোগরা এয়ারপোর্টে বসে আছি, তখন উনি ফোনে জানান যে পুলিশ হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে এসেছে এবং তদন্ত চলছে। সেই পুলিশ কর্মচারীর বিরুদ্ধে তিনি যে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেবেন, সেটাও উনি নিশ্চিত করেন।
যে ঘটনা আমার সাথে হয়েছিল সেটা অন্য কারুর সাথেও হতে পারতো। পরিবার নিয়ে বেড়াতে গিয়ে কোন ব্যক্তি যদি এরকম পরিস্থিতিতে পড়েন, তাহলে তাঁর মানসিক স্থিতি কি হবে আন্দাজ করতে পারছেন? আমি দীর্ঘদিন ধরে পুলিশদের সাথে কথাবার্তা বলায় যে সহজ সম্পর্কটা আছে, যে সুবাদে সেই অধিকারীর নম্বর যোগার করতে পারলাম, সবার তো আর সেটা নেই। তাছাড়া পুলিশি হাঙ্গামা সবাই সচরাচর এড়াতেই চায়। এমতাবস্থায় সেই ব্যক্তির তো জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘ দশা। তাই প্রশাসন যদি ভ্রমনার্থীদের এরকম অসুবিধার কথা মাথায় রেখে বিশেষ সেল বানান, যেখানে পুলিশ থাকলেও নাগরিক পোশাকে থাকুক, যাতে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত না হয়ে পড়েন, তাহলে বোধহয় ভাল হয়। আর যেসব হোটেল ভ্রমনার্থীদের সাথে এরকম রূঢ় আচরণ করছে তাদেরও মাথায় রাখা উচিত যে ভ্রমনার্থীদের জন্যেই তাদের রুজিরোজগার চলছে। তাই পরস্পরের প্রতি সম্মান থাকাটা খুবই প্রয়োজন।

No comments:

Post a Comment