Sunday, February 14, 2021

রাজানুগ্রাহী পান্ডিত্য

মা দুর্গার বাবার নাম যদি হিমালয় বা দক্ষ হয় তাহলে সেই যুক্তিতে শ্রীকৃষ্ণের বাবার নাম দশরথ রামের ছেলের নাম প্রহ্লাদ, তাই না? আসলে পৌরাণিক বিষয়ে কথা উঠলেই বাজারে এসে যায় সেই ধামাধরা কয়েকজনের নাম আর পত্রিকাগুলি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ঐ কয়েকজনেরই কথা ছাপে যেটা তাদের সম্পাদকীয় নীতির সমার্থক হয়।

এই কারণেই নৃসিংহপ্রসাদের মত রাজানুগ্রহ লোভী পন্ডিতরা নিদান হাঁকতেই পারেন যে "প্রশাসক হিসেবেও রাম খুব একটা ভাল ছিলেন না"। তিনি বলেন, “রামায়ণের উত্তরখণ্ডে যে বর্ণনা রয়েছে তাতে প্রশাসক হিসেবে রামের তেমন কোনও অবদানেরই উল্লেখ নেই। প্রজারঞ্জনের জন্য তিনি স্ত্রী ত্যাগ করেছেন। সেটা ভাল করেননি। তিনি সেটা ব্রাহ্মণ্যবাদের চাপে করেছেন।” স্ত্রীর চেয়ে রাষ্ট্রকে কি তিনি প্রাধান্য দেননি? 

এই হচ্ছে আমাদের 'পন্ডিতদের' অবস্থা। একজন রাজা, প্রজারঞ্জনের জন্যে, আপন স্ত্রীকে ত্যাগ করলেও, নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থকে উপেক্ষা করলেও সেটা "খুব একটা ভাল প্রশাসক" হওয়ার পরিচায়ক নয়। আর সেটা প্রমাণের তথ্য নাকি উত্তরাকাণ্ড যেটা আদতে মূল রামায়ণের অংশই নয়। আসলে শাসক দলের কৃপা নিতে নিতে এদের গায়ের চামড়া এতটাই মোটা আর জিভ এতটাই অসাড় হয়ে গেছে যে এখন এরা ঘোমটা ছাড়াই খ্যামটা নাচতে পারে।

এই প্রসঙ্গে অনেক পুরনো একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। রামমন্দির আন্দোলন তখন তুঙ্গে। কলকাতার কলামন্দিরে, দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকা একটা আলোচনাসভার আয়োজন করেছিল যেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন এন.রাম, এম.জে.আকবর, অটল বিহারি বাজপেয়ী সহ বিভিন্ন বক্তা। তপন'দার সাথে আমিও সভাতে গিয়েছি শ্রোতা হিসাবে। বিভিন্ন বক্তা রামকে তীব্র আক্রমণ করে, রামমন্দির আন্দোলনের জন্যে বিজেপিকে সমালোচনা করলেন। তাদের বক্তব্য যে ব্যক্তি নিজের স্ত্রীকে ত্যাগ করতে পারে সে কখনও আদর্শ রাজা হতে পারেনা না।

ঘন্টাখানেক ধরে বিভিন্ন বক্তার বক্তব্য শোনার পর সভা যখন মোটামুটিভাবে রামকে আদর্শ রাজা হিসাবে মানতে নারাজ তখন বক্তব্য রাখতে উঠলেন বাজপেয়ী। আর মাইকে এসে, নিজের স্বভাবসিদ্ধ, অননুকরণীয় ভঙ্গিমায়, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বললেন, "হাঁ, পতি রাম নে ভুল কিয়া থা, রাজা রাম নে নেহী"। গোটা হল মন্ত্রমুগ্ধের মত নিশ্চুপ। এরপর উনি ব্যাখ্যা করে বললেন যে মানুষের বিভিন্ন রুপে বিভিন্ন দায়িত্ব থাকে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বোঝালেন যে, "মনে করুন আপনার বাবার সত্তর বছর বয়স, আর ডাক্তার তাঁকে ধুমপান করতে বারণ করেছেন। তবু আপনি তাঁকে একদিন লুকিয়ে ধুমপান করতে ধরে ফেললেন। উল্টো দিকে, আপনার ছেলের ১৫ বছর বয়স, আপনি তাকেও লুকিয়ে ধুমপান করতে দেখে ফেললেন। এমতাবস্থায়, ছেলেকে আপনি হয়তো একটা চড় মারবেন, কিন্তু বাবাকে চড় মারবেন কি? কিন্তু একই অন্যায় তো দু'জনেই করছে। তবু আপনার আচরণ আলাদা হবে কারণ ছেলের ক্ষেত্রে আপনি পালন করবেন পিতৃধর্ম আর বাবার ক্ষেত্রে আপনাকে পালন করতে হবে পুত্রধর্ম।" এইভাবে, প্রত্যেকটা সম্পর্কেরই আলাদা আলাদা মর্যাদা থাকে আর শ্রীরাম সেটা যথাযথ পালন করেছিলেন বলেই তাঁকে মর্যাদা পুরুষোত্তম বলা হয়"।

তাই আজ যখন নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর মত ব্যক্তিরা রামকে "ব্রাহ্মণ্যবাদের চাপের" শিকার বলে বর্ণনা করেন তখন এদের মেধার প্রতি করুণা হয়। আসলে পান্ডিত্য যখন শাসকের অনুগ্রহের মুখাপেক্ষী হয়ে যায়, তখন এই পরিণতিই স্বাভাবিক।

https://www.anandabazar.com/west-bengal/several-eminent-scholars-criticise-the-comment-on-devi-durga-and-ramchandra-by-dilip-ghosh-dgtl/cid/1266393?utm_source=abp_newsletter&utm_medium=email&utm_campaign=DailyMorningBriefing&tqid=1_C6YyMjD0AB4IOnNFDPQpYnLKdGR8DiC4n1V0Zy

No comments:

Post a Comment