Saturday, January 16, 2021

হঠাৎবাদ

পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইদানীং যে বাঙালীবাদ অথবা বাঙালী জাতীয়তাবাদের ধুয়ো উঠছে সেটা 'অনুপ্রেরণা' মূলত রাজনৈতিক। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থানকে প্রতিহত করাই এই হঠাৎবাদের উৎস। প্রথমে এটা শুরু হয়েছিল তথাকথিত হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, কিন্তু হিন্দির বিরুদ্ধে মুখর হয়ে, উর্দুর বিরুদ্ধে মৌন থাকার চালাকিটা রাজ্যের ঘরপোড়া মানুষ বুঝে ফেলতেই এখন হিন্দি আর উর্দু- উভয়কেই নিশানা করা হচ্ছে।

কিন্তু এই তথাকথিত বাংলাপ্রেমীদের (অন্য অর্থে নেবেন না) মূল সমস্যা হল যে তাদের হিসাবে ভাষাই জাতির একমাত্র পরিচায়ক। তাই তাদের কাছে, দেশের পূর্বদিকের সীমান্তের পূর্ব ও পশ্চিমে বসবাসকারী উভয়েই বাঙালী। তাদের মনে কি কখনও প্রশ্ন জাগেনা যে উভয়পারের লোকের পরিচয় যদি বাঙালীই হবে তাহলে মাঝখানে সীমান্তটা আসলো কেন? হয়তো জাগে, কিন্তু রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা এবং কাঞ্চনমূল্যে সেই প্রশ্ন চাপা পড়ে যায়। তারা বোঝেনা বা বুঝতে চায়না যে ভাষা কখনও জাতির একমাত্র পরিচায়ক হতে পারেনা, কোন জাতির পরিচয় হল তার সংস্কৃতি। সীমান্তের পশ্চিমপারে বাঙালীদের সংস্কৃতি আর পূর্বপারে বাংলাভাষীদের সংস্কৃতি এখন আর এক নয়। সুজলা সুফলা পূর্বপারের অধিকাংশ মানুষ তাদের জন্যে এমন এক মরু সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেছেন যেটা অন্য কোন সংস্কৃতির অস্তিত্ব মেনে নিতে পারেনা। আর সেই কারণেই রামধনু হয়ে যায় রঙধনু আর বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তির মত, ঢাকাতেও ভাঙা হতে থাকে মন্দির, মূর্তি। কারণ সেটা সেই মরু সংস্কৃতি অনুসারে, হারাম।

আগেই বলেছি যে এই হঠাৎবাদের অনুপ্রেরণা ও স্পনসর যেহেতু রাজ্যের বর্তমান শাসক দল এবং একমাত্র লক্ষ্য বিজেপির অগ্রগতি রোধ করা, তাই বাজারে আরও একটা নতুন তত্ত্ব আসছে আর সেটা হল হিন্দু বাঙালী জাতীয়তাবাদ। বিজেপি যেহেতু হিন্দু জাতীয়তাবাদকে পুঁজি করে আন্দোলন করছে, তাই সেই আন্দোলন থেকে বাঙালীদের আলাদা করা (পড়ুন ভোট কাটা) এই নতুন দলের লক্ষ্য। আর এই লক্ষ্যে মূলত তারাই কাজ করছে যারা এতদিন বিজেপির দুয়ারে হত্যে দিয়ে পড়েছিল আর এখন সেখানে পাত্তা না পাওয়াতে তাদের মনে হয়েছে যে বিজেপিকে দিয়ে কিছু হবেনা। ভাবটা এমন যেন বিগত দশ বছরে বিজেপিই এই রাজ্যে ক্ষমতায় ছিল আর কাংলাপাহাড়িতে দুর্গাপূজা বন্ধ বা তেহট্ট হাই স্কুলে সরস্বতীপূজা বন্ধ বিজেপিই করেছে। মহরমের জন্যে বিসর্জন বন্ধ করা বা তোতোন দাস, রোহিত তাঁতিদের হত্যাও হয়েছে বিজেপি প্রশাসনের কারণে। সমুদ্রগড়ের নিরীহ ছেলেদের, শুধু রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে, গাঁজা কেসে ফাঁসিয়ে, তিন বছর ধরে আটকে রেখেছে বিজেপি প্রশাসন আর তারক বিশ্বাসকে গ্রেপ্তারও করেছিল বিজেপি প্রশাসন। এরপর হয়তো শুনবো যে ইমামভাতা আর OBC-A সংরক্ষণ আইনও বিজেপিরই অবদান। সত্যি, মানুষকে এতটা বোকা ভাবেন? ভাবতে পারেন?

মাফ করবেন, সাধারণ মানুষ নিজেদের দৈনন্দিন জীবনধারণের লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকে বলে রাজনৈতিক ঝঞ্জাটে বেশী জড়াতে চায়না ঠিকই কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাদের রাজনৈতিক চেতনা নেই। কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল- সেটা তারা বোঝে, হ্যাঁ, পরিস্থিতির কারণে সবসময় সেটা নিয়ে সোচ্চার হতে না পারলেও, বোঝে আর সুযোগের অপেক্ষায় থাকে সেই ভুল শোধরাবার। ভারতের গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, প্রতি পাঁচ বছর অন্তর তাঁদের কাছে সুযোগ আসে সেই ভুল শোধরাবার। আগামী সপ্তাহে নির্বাচন কমিশনের টিম এই রাজ্যে আসছেন, হয়তো মার্চ মাস থেকে নির্বাচন শুরু হওয়ার কথা ঘোষণাও করে দেবেন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ সেই ঘোষণার অপেক্ষায় বসে নেই, তাঁরা মনস্থির করে নিয়েছেন যে কিভাবে জবাব দেবেন। কেউ তাঁদের বিপথে চালানোর চেষ্টা করতেই পারে, কিন্তু সেটাতে বিশেষ লাভ হবেনা।

No comments:

Post a Comment