Thursday, April 15, 2021

ভোটরঙ্গ

জনগণ সাধারণগত দুটি কারনে ভোট দেন- ১) কোন দলের কাজে খুশি হয়ে সেই দলের পক্ষে ভোট। এটা পজিটিভ ভোট। আর ২) কোন দলের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে সেই দলের বিরুদ্ধে ভোট। এটা নেগেটিভ ভোট। পজিটিভ ভোটের ক্ষেত্রে দল নির্দিষ্ট থাকলেও নেগেটিভ ভোটের কিন্তু সেরকম কোন দল নেই। যে দলের বিরুদ্ধে মানুষ বীতশ্রদ্ধ, সেই দলকে হারানোর জন্যে বিভিন্ন এলাকার মানুষ সেই এলাকায় যে দল শক্তিশালী বিকল্প হতে পারে, তাকেই ভোট দেয়।

শাষক দল বরাবরই চেষ্টা করে পজিটিভ ভোট করানোর আর তাই আদর্শ নির্বাচনী বিধি বলবৎ হওয়ার আগে পর্যন্ত সরকারী খরচে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিজেদের সাফল্যের খতিয়ান প্রচার করে। ভোট প্রচার পর্বেও তারা পজিটিভ ভোটের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করে। উল্টোদিকে, বিরোধী দলগুলির চেষ্টা থাকে নেগেটিভ ভোটের সংখ্যা যাতে বেশি হয়। 

এই চিরাচরিত পদ্ধতির ব্যতিক্রম দেখা গিয়েছিল ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের সময়। তখন ক্ষমতাশীল কংগ্রেস নিজের পজিটিভ ভোট বাড়ানোর বদলে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে নেগেটিভ ভোট তৈরি করার পরিকল্পনা নিয়েছিল। উল্টোদিকে নরেন্দ্র মোদী বিরোধী দলের হয়েও তাঁর প্রচারে জোর দিয়েছিলেন বিজেপির পজিটিভ ভোট তৈরি করতে। ফলাফল কি হয়েছিল আজ সেটা ইতিহাস।

এরাজ্যে এবারের বিধানসভা নির্বাচনেও এরকমই এক নতুন সমীকরণের খেলা চলছে। শাসকদল হিসাবে তৃণমূল কংগ্রেস শুরুতে পজিটিভ ভোট তৈরির চেষ্টায় থাকলেও ক্রমেই সেটা পরিণত হচ্ছে বিরোধী দলগুলির, থুড়ি, এখন তো রাজ্যে আর বিরোধী দলগুলি বলা যাবেনা কারণ দিদি ইতিমধ্যেই অপারেশন সূর্যোদয়ের ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বাবুকে সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেন, তাই বলা ভাল যে বিজেপির বিরুদ্ধে নেগেটিভ ভোট তৈরির প্রচেষ্টায়। শাসকদল যখন পজিটিভ থেকে নেগেটিভ ভোটকে বেশি গুরুত্ব দেয় তখন এটা বোঝা যায় যে তার পায়ের তলার মাটি সরতে শুরু করেছে। 

২০১৬ সালে মমতা ব্যানার্জীর সৌভাগ্য ছিল যে এরাজ্যের মানুষের মনে সিপিএমের প্রতি বিদ্বেষ তখনও এতটাই তীব্র যে তিনি সেই সেন্টিমেন্টের জোরেই সেবারের মত বৈতরণী পার হয়ে গেছেন। কিন্তু তার সরকারের মুসলিম তোষন নীতি যে রাজ্যের জনগণ ভালভাবে মেনে নেয়নি তার প্রমান যে হিজাব পরে মুসলিমদের জন্যে দানছত্র খোলার পরেও আজ মমতাকেও নিজের হিন্দু পরিচয় জাহির করতে হচ্ছে কারণ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির আকাশে বিজেপির আবির্ভাব। 

বিজেপির আবির্ভাবের সাথে সাথেই, এই রাজ্যে যে 'হিন্দু ভোট' বলেও একটা বিষয় হতে পারে সেটা উপলব্ধি করেছেন সাধারণ মানুষ। না, ব্যাপারটা এমন নয় যে রাজ্য বিজেপির নেতারা দারুণ হিন্দু হিতৈষী বা হিন্দুদের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন, বরং তারা তো এতটাই উদার যে নিজেদের দলীয় কর্মীকে খুনের দায়ে অভিযুক্তকেও সাদরে বুকে টেনে নেন। প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে এরপরেও হিন্দুরা বিজেপির উপর ভরসা করছে কেন বা বিজেপির প্রভাব বাড়ছে কেন, উত্তর একটাই - নরেন্দ্র মোদী। হ্যাঁ, এটা রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন হলেও বিজেপি এটাকে সফলভাবে দেখাচ্ছে মোদী সরকারের গঠন রূপে আর রাজনীতি যেখানে perception এর খেলা, নরেন্দ্র মোদী সেখানে ক্রিকেটের তেন্ডুলকর আর ফুটবলের পেলে।

যে 'হিন্দু ভোট' এতদিন অবহেলিত ছিল আজ তারা বিজেপির সুবাদে একটা আওয়াজ পেয়েছে। বাকি দলগুলি যেখানে 'সেকুলার' হয়ে থাকার তাগিদে ক্রমাগত হিন্দুদের অস্তিত্ব ও অধিকার নিয়ে আপোষ করে গেছে, বিজেপি সেই যায়গাটাতেই নিজেদের সাফল্যের ভিত্তি বানিয়েছে। আজ মমতা ব্যানার্জী বিজেপিকে যতই বহিরাগত বলুন না কেন, বাস্তবে তার দলও আজ বহু যায়গায় রাম নবমী পালন করতে বাধ্য হচ্ছে যে রাম নবমীকে বছর দুয়েক আগেও তিনি ও বাংলার তথাকথিত বুদ্ধিজীবিরা বিজাতীয় সংস্কৃতি বলে অবিহিত করেছিল। আজ রাম নবমী শুধু একটা পুজো বা উৎসব নয়, হিন্দুদের দাপট দেখানোর মঞ্চ।

২০১৯ এর নির্বাচনে ভরাডুবির পর, এবার বামপন্থীদের কাছেও নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধি করার ভাল সুযোগ ছিল। লকডাউনের সময় বিভিন্ন যায়গায়, বিশেষত রাঢ় বঙ্গে, ত্রাণ দিতে গিয়ে দেখেছি যে বামপন্থীরা সাধারণ মানুষদের সেবায় অনেক কাজ করেছেন। হেঁসেল খুলে খাওয়ানো হোক বা ভিনরাজ্য থেকে আগত শ্রমিকদের সাহায্য, বামপন্থীরা যথেষ্ট ভাল কাজ করেছেন। করোনা অতিমারী, লকডাউনের আর অর্থনৈতিক নিম্নগতির ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল সেটাকে কিভাবে নিজেদের দলীয় স্বার্থে কাজে লাগাতে হয় সেটা বামপন্থীদের থেকে ভাল আর কেউ জানেনা কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্য যে তাদের নেতৃত্ব সমঝোতা করে বসলো আব্বাস সিদ্দিকীর সাথে। আব্বাসের সাথে সমঝোতা করে বামপন্থীদের যতটা না লাভ হবে, ক্ষতি হয়েছে তার থেকে অনেক বেশী। সাধারণ হিন্দু ভোটার যারা সংখ্যালঘু তোষণের কারণে তৃণমূলের উপরে এবং একইসাথে অর্থনৈতিক এবং তৃণমূলের দলত্যাগীদের আশ্রয় দেয়ার কারণে বিজেপির উপরে ক্ষিপ্ত ছিলেন এবং বিকল্প হিসাবে হয়তো বামপন্থীদের বেছে নিতেন, তারা আব্বাসের কারণেই আর বামপন্থীদের ভোট দেবেন না। ফলে, জোটের কারণে যদি কারুর লাভ হয়ে থাকে তাহলে সেটা আব্বাসের আর বিজেপির। কুয়োর ব্যাঙ আব্বাস পেয়ে গেছে গোটা রাজ্যের বিচরণক্ষেত্র আর বিজেপির লাভ হলো তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ ভোটারদের বিকল্প কোন পথ না থাকা।

আর মমতা ব্যানার্জী ও পিকে এটা বুঝেছেন বলেই তারা চাইছেন বামপন্থীরা একটু চাঙ্গা হোন। নন্দীগ্রাম গুলি কান্ডে বুদ্ধদেবকে ক্লিনচিট দেয়ার একমাত্র কারণ দলের ক্যাডারদের চাগানো। মমতা নিজে দলের ৪২-৪৪% শতাংশ ভোট ধরে রাখার ব্যাপারে নিশ্চিত তাই তার লক্ষ্য বামপন্থীদের ভোটের পরিমাণ ২০১৯ সালের ৭% থেকে অন্তত ১৫-১৮ শতাংশে নিয়ে যাওয়া যাতে বিজেপির যাত্রা পন্ড হয়। উল্টোদিকে বামপন্থীরা আবার মমতাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর বিষয়ে বেশী আগ্রহী তাই তারাও আব্বাসকে জড়িয়ে ধরে নিজেদের ভোট কমাতে বদ্ধপরিকর। অনেকটা সেই "কেবা আগে প্রাণ করিবেক দান, তার লাগি তাড়াতাড়ি"-এর মত কেস।

এমতাবস্থায়, এইবারের নির্বাচনের ফলাফল খুবই আকর্ষণীয় হতে চলেছে। বামপন্থীরা যদি নিজেদের ভোট বাড়াতে পারে তাহলে বহু আসনের ফলাফল নির্ধারিত হবে খুব অল্প মার্জিনের ভিত্তিতে আর ২০১৯ এর মতই যদি বাম বিলীন হয়ে যায় তাহলে বিজেপি বলীয়ান হবেই। সেক্ষেত্রে, দ্বিমুখী লড়াই হলে অবশ্যই অ্যাডভান্টেজ বিজেপি।

No comments:

Post a Comment