Thursday, February 20, 2020

ভারতের রাজনৈতিক দিশা

বর্তমানে হিন্দুত্ববাদী বা জাতীয়তাবাদীদের (দুটোই আমার কাছে সমার্থক কারণ ভারতে হিন্দুত্বই জাতীয়ত্ব) একটা স্বাভাবিক ঝোঁক বিজেপির প্রতি রয়েছে। জাতীয়তাবাদ কোন একটা বিশেষ দলের পেটেন্ট হতে পারেনা কারণ জাতির ব্যাপকতা পার্টির থেকে অনেক অনেক বেশী, কিন্তু তবুও ভারতে এই মনোভাবের প্রচলন ঘটেছে এবং ক্রমশ এই মানসিকতার উপর ভিত্তি করেই যাবতীয় মেরুকরণ ঘটছে। এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে তবে মূখ্য কারণ দু'টো।

এক) দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ও তার শাখা সংগঠনগুলি সমাজের বিভিন্ন স্তরে এই কাজের জমি তৈরী করে আসছে। সঙ্ঘের যেকোন শাখা সংগঠনেরই, সেটা বিদ্যার্থী পরিষদ হোক মজদুর সঙ্ঘ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ হোক বা বনবাসী কল্যাণ আশ্রম, অন্যান্য সাংগঠনিক কাজের সাথে পরোক্ষভাবে জুড়ে থাকে বিজেপির শক্তিবৃদ্ধির লক্ষ্য। তাই এই সংগঠনগুলির সাথে যারা যুক্ত থাকেন তারা বিজেপি ক্ষমতায় থাকলে যেমন কিছু বাড়তি সুবিধা পান, তেমনিভাবেই অবিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসলে এদের প্রভাব দমন করার চেষ্টা করেন। ফলে, বিজেপির প্রতি এদের নির্ভরশীলতা ও আসক্তি ধীরে ধীরে বেড়ে যায়।

দুই) বিজেপি বাদে অন্যান্য দলগুলির নেতৃত্ব, আবার বলছি, নেতৃত্ব, সাধারণ কর্মীরা নয়, সেকুলার সাজার জন্যে ওরফে মুসলমানদের ভোট পাবার জন্যে হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাস ও স্বার্থের পরিপন্থী কথা বলে, নিজেদেরকে হিন্দুদের থেকে ক্রমশ দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন। যতদিন সবক'টা দল এই কাজ করতো এবং বিপরীত চিন্তা যোগানোর কোন বিকল্প ছিলনা, ততদিন তাদের রুজিরোজগারের অসুবিধা হয়নি। কিন্তু যে মূহুর্তে হিন্দুদের তথা জাতীয়তাবাদের পক্ষে কথা বলার মত বিকল্প শক্তির আবির্ভাব হয়েছে, এদের চিরাচরিত পরিকল্পনা ধাক্কা খেয়েছে।

বিজেপি নিজেও এই সেকুলার রোগ থেকে মুক্ত নয় আর সেই কারণেই এককালে বিজেপিতে হিন্দুত্বের পোস্টারবয়, আদবানী, জিন্নাহ কে সেকুলার বলেছিলেন, বাবরি মসজিদ ভাঙার দিনকে নিজের জীবনের কালো দিন বলেছিলেন এবং গুজরাটে হিন্দুদের লড়াইকে সরকারের উপর দাগ বলে বর্ণনা করেছিলেন। আর সেই কারণেই ছয় বছর ভালভাবে সরকার চালানোর পরেও বাজপেয়ী সরকার ক্ষমতায় ফিরতে পারেননি। কারণ দলের সমর্থকেরা বিজেপির থেকে এই রূপ প্রত্যাশা করেননা। তাই সেই আদবানীই ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হলে, দেশ তাকে প্রত্যাখ্যান করে।

নরেন্দ্র মোদী আর অমিত শাহর সাফল্য হল যে তাঁরা এই জাতীয়তাবাদকে, নিজেদের ইমেজের সাথে সুচারুভাবে মিশিয়ে দিতে পেরেছেন। সার্জিক্যাল স্ট্রাইক বা বালাকোটে এয়ার স্ট্রাইকের মত সামরিক অভিযানকে তাঁরা কঠোর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রমাণ হিসাবে প্রতিপন্ন করতে পেরেছেন। অথচ মমতা ব্যানার্জীর আমলে কাটোয়ার ত্রাস, জঙ্গল শেখ সহ বহু মুসলমান অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে, জেলে ভরা হলেও মমতা সেগুলোকে কখনও নিজের সাফল্য বলে প্রচার করতে পারেননি, পাছে মুসলমানদের ভোট সরে যায়। এমন নয় যে মোদী বা শাহর আমলে মুসলমান তোষণ হয়নি, জমজমের পানি আনার জন্যে মুসলমানদের বিশেষ অনুমতি দেয়া হোক বা ইউপিএ আমলে ৯০ টা জেলায় শুরু হওয়া মুসলমানদের উন্নয়ন কাজকে ৩০৮ টা জেলায় ছড়িয়ে দেয়া হোক, মোদী সরকার কারুর থেকেই পিছিয়ে নেই। কিন্তু তাদের সুবিধা হল যে এই বিষয়ে তাদের আক্রমণ করার মত কোন দল নেই কারণ সবাই মুসলমানদের ভোটের লোভে মত্ত। অথচ অন্য কোন দল একই কাজ করলে, বিজেপি অনায়াসেই তাদের আক্রমণ করে, নিজেদের ভোটব্যাঙ্ক আরও সংগঠিত করতে পারে।

এমতাবস্থায়, বিরোধী দলগুলিকে যদি বিজেপির সঙ্গে প্রকৃত মোকাবিলা করতেই হয় তাহলে তাদেরকে বিজেপির গড়ে হামলা করতে হবে। মানে নিজেদের সেকুলার সাজার লোভ সংবরণ করে, জাতীয়তাবাদী মনোভাব গ্রহণ করতে হবে। লক্ষ্য করে দেখুন, সদ্য দিল্লী নির্বাচনে বিপুল সাফল্য পাওয়া কেজরীওয়াল, নিজে CAA-র বিরোধী হলেও, কিন্তু শত প্রলোভন সত্ত্বেও, একবারও শাহিনবাগে যাননি বা তাদের সমর্থনে কোন কথা বলেননি। আর সেই কারণেই শাহিনবাগ নিয়ে দিল্লী নির্বাচনে মেরুকরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে বিজেপি। বিরোধী দলগুলি যদি এখনও সংখ্যালঘু ভোটের আশায়, সংখ্যাগুরুর আবেগ ও স্বার্থগুলিকে অস্বীকার করতে থাকে তাহলে আগামী লোকসভা নির্বাচনেও বিজেপির বিজয়রথ থামবেনা।

No comments:

Post a Comment