Thursday, February 24, 2022

যুদ্ধের পরিণতি

কম্যুনিস্টদের চিরকালীন স্লোগান "লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই" আর যুদ্ধ শুরু হলেই সেই স্লোগান বদলে "যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই" এর ভনিতা মাথায় রেখেই বলছি যে আমি যুদ্ধের পক্ষপাতী নই। শুধু আমি কেন, আমার মনে হয় যুদ্ধের প্রতি আকর্ষণ কেবল তাদেরই রয়েছে যাদের পরিবারের কেউ কখনই যুদ্ধক্ষেত্রে যায়নি। সৈনিক যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত থাকে কিন্তু সে কখনও যুদ্ধ চায়না। দুর্ভাগ্যবশত, যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতাটা সৈনিকের হাতে থাকেনা।


যুদ্ধ একেবারে অন্তিম পথ আর সেই পথ বেছে নেয়ার আগে, যাবতীয় বিকল্প পর্যালোচনা করে দেখা দরকার। এই কারণেই, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠার সময়েও স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ, শান্তিদূত হয়ে, কৌরব রাজসভায় গিয়েছিলেন এবং পান্ডবদের প্রতি হওয়া যাবতীয় বঞ্চনার প্রতিদান হিসাবে মাত্র পাঁচটা গ্রাম প্রার্থনা করেছিলেন। কংস ও শিশুপালকে বধ করা শ্রীকৃষ্ণের এহেন সিদ্ধান্তে অখুশি হয়ে, দ্রৌপদী তাঁকে নিজের খোলাচুল দেখিয়ে, দুঃশাসনের রক্ত দিয়ে সেই চুল বাঁধার প্রতিজ্ঞা মনে করালে শ্রীকৃষ্ণ তাকেও তিরস্কার করে বলেন যে যুদ্ধ হলে যত সৈন্য নিহত হবেন, তাদের প্রাণের থেকে দ্রৌপদীর চুলের মূল্য বেশী নয়।


ভাবুন তো, অপারেশন পরাক্রমের সময়, "ইস বার আড়-পার কি লড়াই হোগি" বলে সৈন্যদের সীমান্তে নিয়ে গিয়ে, একটাও গুলি ছোঁড়ার আদেশ না দিয়ে, যখন ফিরিয়ে আনা হলো তখন দেখা গেল যে সেই কাজে, অপারেশন বিজয়, মানে কার্গিল বিজয়ের অভিযান থেকেও বেশী সৈন্য মারা গেছেন। সৌরভ কালিয়া, হেমরাজ, সন্তোষ বাবু, রাজেশ ওরাং, গঙ্গাধর দোলুই বা বিশ্বজিত ঘোড়াইয়ের মত অসংখ্য সৈনিক যারা দেশের হয়ে যুদ্ধে প্রাণ বলিদান দিয়েছেন তাদের কতজনের কথা আমাদের মনে আছে? ১৫ই আগস্ট আর ২৬শে জানুয়ারির দেশভক্তি বাকি ৩৬৩ দিন হারিয়ে যায়।


আর এটা দোষের নয়, বরং এটাই স্বাভাবিক। ঠিক ততটাই স্বাভাবিক শহীদদের পরিবারের তাদের সদস্যর অনুপস্থিতি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করা। কেউ হারায় সন্তান, কেউ স্বামী আর কেউ তার বাবাকে। হ্যাঁ, এদের অনেকেই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সামরিক সম্মান পান কিন্তু সেটা কখনই তাদের উপস্থিতির বিকল্প নয়। অশোকচক্র খোদিত সার্টিফিকেট মানে সেটা রাজনৈতিক শাসনের স্বীকৃতি কিন্তু সমাজ কতদিন তাদের বলিদানকে মনে রাখে? কাশ্মীর হোক বা নকশাল অধ্যুষিত এলাকা - প্রায়শই শহীদ হন আমাদের জওয়ান, কতজন জানি তাদের কথা?


তাই যুদ্ধ হওয়া উচিত অন্তিম বিকল্প আর সেই যুদ্ধ এমন হওয়া উচিত যাতে সেই যুদ্ধের পরবর্তীতে বাকি সব যুদ্ধের সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা খেলে, সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে, কর্পোরেট দুনিয়ার খবরদারি কাম্য নয়। রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের আবহে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যে বার্তালাপের উদ্যোগ নিয়েছেন আশা করি সেটা কার্যকর হবে এবং যুদ্ধের ছায়া কেটে যাবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে বর্তমানে যুযুধান পক্ষের কাছে যেসব মারণাস্ত্র আছে সেগুলি ব্যবহৃত হলে পরবর্তী যুদ্ধ কিন্তু আবার সেই তীর-ধনুক দিয়ে লড়তে হবে।

No comments:

Post a Comment