Tuesday, March 9, 2021

মনুস্মৃতি ও নারী স্বাধীনতা

বছরখানেক আগেও একটা ফ্যাশন ছিল যে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে মনুস্মৃতি পোড়ানো। এই কাজের নেতৃত্বে প্রধানত থাকতো দিল্লীর জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। মনুস্মৃতি পুড়িয়ে তারা নিজেদের বিপ্লবী সত্ত্বার প্রমাণ দিত, ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতো, আর সবশেষে সনাতন ধর্ম যে ব্যাকওয়ার্ড সেটা তুলে ধরার করতো।

প্রথমত, যেসব ছাত্ররা নারীস্বত্বার অবমানকারী মনুস্মৃতি পুড়িয়ে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতো তারা একই কারনে, মনুস্মৃতির সাথে কোরানও পুড়াতনা কেন? কোরান অনুসারে নারীর অস্তিত্ব শুধু সন্তান উৎপাদনকারী হিসাবে। পুরুষের যৌন ইচ্ছা চরিতার্থ করা ছাড়া তাদের আর কোন স্বত্বা নেই। এরপরেও কি প্রতিবাদকারীরা বিশ্বাস করে যে কোরান নারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছে?

দ্বিতীয়ত, বেদে স্ত্রীলোকের বেদপাঠের অধিকার নেই বলে যারা উল্লেক করে তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই "স্ত্রীশূদ্রদ্বিজবন্ধনাং ত্রয়ী ন শ্রুতিগোচরা" শ্লোকটির উল্লেখ করে থাকেন কিন্তু এটিও কোন বৈদিক সূত্র নয়। এটির রচনাকাল খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের মধ্যে কারন সেই সময়েই সূত্রসাহিত্য সংকলিত হয়। শ্লোকে তিন প্রকার ব্যক্তির কাছে বেদপাঠ নিষিদ্ধ বলা হয়েছে কিন্তু ছান্দোগ্যোপনিষদে বলা হয়েছে যে


"যথেয়ন্ন প্রাকত্বত্ত: পুরা বিদ্যা ব্রাহ্মণান

গচ্ছতি তস্মাদুসর্ব্বেষু লোকেষু ক্ষত্রস্যৈব

প্রশাসনমভূদিমি" - ছান্দোগ্য ৫|৩|৭|

অর্থাৎ, বাহ্মণদের সমান্তরালে আদিযুগে ক্ষত্রিয় রাজারাও ব্রহ্মবিদ্যা লাভ করতেন আর ব্রাহ্মণরা তাঁদের শিষ্যত্বও গ্রহণ করে থাকতেন। যেমন বিশ্বামিত্র মুনি, কাশীমহিষী মদালসা প্রমুখ।

এছাড়া, বৃহদারণ্যকোপনিষদে ইহার রচয়িতা যাজ্ঞবল্ক্য স্বয়ং স্বীকার করে গেছেন জনক রাজার সভায় তাঁর সঙ্গে মহীয়সী গার্গীর কথোপকথনের ইতিবৃত্ত। এখানে মনে রাখা দরকার যে সিনেমায় হিরো যেমন সবার শেষে এন্ট্রি নিয়ে সবাইকে মাত করে দেয় তেমনই ভাবে ঐ সভায় যাজ্ঞবল্ক্যর সাথে জনকরাজের কূল পুরোহিত অশ্বল, আর্তভাগ ঋষি, চাক্রায়ণ উষস্ত, কৌষীতকেয় কহোল এদের সবার শেষে গার্গী উঠে দাঁড়িয়েছিলেন এবং তার প্রশ্ন দ্বারা যাজ্ঞবল্ক্যকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছিলেন যে মহর্ষি বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে "গার্গী মাতিপ্রাক্ষীর্মা তে মূর্ধ্বা ব্যপপ্তৎ"(৩|৬|১) অর্থাৎ গার্গী আর বেশী প্রশ্ন করনা, তোমার মাথা খসে পড়বে। বলা বাহুল্য যে এই সতর্কবাণীর মধ্যে ঋষিবরের পরাজয়ের ব্যঞ্জনাই ফুটে উঠেছে। কিন্তু ভুললে চলবে না যে বৃহদারণ্যকোপনিষদ স্বয়ং যাজ্ঞবল্ক্যের রচনা। তিনি চাইলে এই বিরম্বনার কথা উহ্য রাখতে পারতেন কিন্তু নিজের ত্রুটির এই স্বীকৃতি ভারতীয় সংস্কৃতির একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

বৈদিক যুগেও নারীশিক্ষার দুটি ধারা লক্ষ্য করা যায়- ১) ব্রহ্মবাদিনী এবং ২) সদ্যোদ্বাহা। বিয়ের আগে যারা গুরুগৃহে বা নিজগৃহে বিদ্যালাভ করতেন তাদের বলা হত বহ্মবাদিনী আর বিবাহিতা অথবা বৈধব্যদশায় যারা বিদ্যাচর্চা করতেন তাদের বলা হত সদ্যোদ্বাহা। বৈদিকযুগে স্বামীস্ত্রী যে একত্রে যজ্ঞে অংশগ্রহণ করতেন, অর্থাৎ স্ত্রীরও যে ধর্মাচরণে সমানাধিকার ছিল, তার বহু প্রমান আছে। "বি ত্বা ততস্রে মিথুনা অবস্যবো ব্রজস্য সাতা..."। ঋগ্বেদ (১|১৩১|৩)। অর্থাৎ যজমান দম্পতি যৌথভাবে অগ্নিকে আহুতি দিচ্ছেন। পঞ্চম মন্ডলের আঠাশতম সূক্তে অগ্নিদেবতাকে বলা হয়েছে "সং জস্পত্যং সযমমা কৃণুস্ব" অর্থাৎ আপনি আমাদের দাম্পত্যসম্পর্ক শৃঙ্খলাবদ্ধ করুন (৫|২৮|৩)। শুধু ঋগ্বেদের সূত্রকারদের মধ্যে অন্তত ২৭ জন ছিলেন মহিলা। তাদের মধ্যে গার্গী, যাজ্ঞবল্ক্যর পত্নী মৈত্রেয়ী, বিশ্ববারা প্রমুক। এছাড়াও আছেন অগস্ত্যপত্নী লোপামুদ্রা, অত্রির কন্যা অপালা, ঋষি কক্ষিবৎ কন্যা ঘোষা, অম্ভৃণ কন্যা বাক এবং ইন্দ্রের পত্নী ইন্দ্রাণী। সেকালে কুমারী মেয়েদের উপনয়ন হত, তাদের সাবিত্রীমন্ত্র জপ ও অধ্যাপনের অধিকারও ছিল- "পুরাকল্পে কুমারীণাং মৌঞ্জী বন্ধনমিষ্যতে / অধ্যাপং চ বেদানাং সাবিত্রীবচনং তথা"। 

এরপরে বেদের শিক্ষার পথে আবির্ভূত হল দুটি অন্তরায়- ১) বেদবিরোধী কর্মবাদের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব আর ২) শ্রুতিপথরোধী জ্ঞানবাদের প্রবক্তা জৈন তীর্থঙ্করের দল। চার্বাকের লোকায়ত দর্শনও এই ক্ষেত্রে অনেকটাই দায়ী। এইসবের প্রভাবে শ্রুতি পরিণত হল স্মৃতিতে। আর আবির্ভাব হল মেধাতিথি, কুল্লুকভট্ট প্রমুখ টিকাকারদের। বেদের সময় প্রতিটি সিদ্ধান্তের হিতাহিতের ব্যাক্ষা দেয়া হত কিন্তু স্মার্ত পন্ডিতরা ব্যাক্ষা দেবার ধারকাছ দিয়ে গেলেন না বরং মুসলিমদের ফতোয়ার মত আপ্তবাক্য ধরনের হুকুম জারী করতে থাকলেন। বৈদিক কালে মেয়েদের বিয়ের বয়স সচরাচর ষোলো-সতের ধরা হত কিন্তু এই যুগে সেটা কমিয়ে আনা হল নয়-দশে। কেন? সেটার ব্যাক্ষা দেবার দায় স্মার্ত পন্ডিতদের নেই। মুসলিম আক্রমণ নারীদের পর্দানশীন করে তুললো। তারা ক্রমে শিক্ষার অধিকার হারালো। আর টুলো পন্ডিতরা নিদান হাঁকলো যে অক্ষর পরিচয় আর অকাল বৈধব্য নাকি পরস্পর সম্পর্কিত।

কিন্তু হিন্দুধর্মের মহত্ব এখানেই যে তারা চিরকাল বিবর্তিত হয়ে চলেছে। কালের নিয়মে সমাজে গোঁড়ামি এসেছে কিন্তু হিন্দুরা সেটাকে আঁকড়ে বসে থাকেনি। তাই মনু যেখানে বেদকে সর্বসমক্ষে প্রকাশ করতে মানা করছেন সেখানে ব্যাসদেব বলছেন "ভবন্তু বহুলা: সন্তু বেদো বিস্তর্য্যতাময়ম" অর্থাৎ এই বেদবিদ্যা ছড়িয়ে পড়ুক। এই কারনেই হিন্দু সমাজে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, নারায়ণ গুরু বা দয়ানন্দ সরস্বতীর মত ব্যক্তিদের জন্ম হয় যারা সমাজকে কুসংস্কারের জাল থেকে বের করে এক নতুন স্তরে উন্নীত করেন।

তাই মনুস্মৃতি পুড়িয়ে নারী স্বাধীনতা উদযাপনকারীদের কাছে অনুরোধ যে আপনারা যদি সত্যিই নারীদের স্বাধীনতা নিয়ে সচেতন থাকেন তাহলে মনুস্মৃতির সঙ্গে কোরানটাও পুড়ান। কারন হিন্দুসমাজ নিজেকে মনুস্মৃতির নিদান থেকে মুক্ত করে ফেলেছে কিন্তু মুসলিমরা আজও সেই কোরানের বন্ধনে আবদ্ধ রয়ে গিয়েছে। তবে তাদের সেই ক্ষমতা যে সেটা তারাও জানে আর আমরাও জানি। কারণ দিনের শেষে, ঘাড়ের উপর তো একটাই মাথা আছে, তাই না?

1 comment:

  1. প্রসূনবাবু, লেখা টি পড়ে ভালো লাগলো। এইরকম আরও article লিখতে থাকুন, ধন্যবাদ

    ReplyDelete