Saturday, June 19, 2021

কালনেমির লঙ্কাভাগ

জাতীয় সুরক্ষার নামে পশ্চিমবঙ্গের বিভাজন করার পরিকল্পনা আসলে বিজেপির রাজনৈতিক হতাশার প্রতিফলন। বিগত বিধানসভা নির্বাচনের আগে থেকে, সম্পূর্ণ কম্যুনিস্ট কায়দায়, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্বেষ গড়ে তোলার কাজ করে চলেছে বিজেপি। কম্যুনিস্টদের শ্রেণীশত্রুর অনুকরণে, বিজেপি জন্ম দিয়েছে জাতিশত্রুর। বাঙালীর সাথে অবাঙালীর, জেলার সাথে শহরের, এমনকি একই এলাকার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যেও, নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে, পারস্পরিক বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজ করে গেছে বিজেপি ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলি। এককালে এই পদ্ধতি নিয়েছিল বামপন্থীরা। কৃষকের সাথে জমির মালিকের দ্বন্দ্ব, শ্রমিকের সাথে কারখানা মালিকের দ্বন্দ্ব, ছাত্রের সাথে শিক্ষকের দ্বন্দ্ব ইত্যাদি। অথচ মজার কথা হলো, বিরোধরত প্রতিটা পক্ষেরই প্রতিনিধিত্ব করতো বামপন্থীরা। পশ্চিমবঙ্গে, নির্বাচনের আগে, বিজেপিও ঐ একই লাইন নিয়েছিল।

সমাজের এই ভেদাভেদকে কাজে লাগিয়ে, বিজেপি ভেবেছিল, বিরাট সাফল্য পাবে। কিন্তু নির্বাচনের ফলপ্রকাশের পর যখন সেই স্বপ্ন ভেঙে যায় তখন সেটা গ্রহণ করা তাদের পক্ষে সহজ হয়না। পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন ছিল মোদী আর শাহর কাছে সম্মান রক্ষার লড়াই আর সেই লড়াইয়ে, অযোগ্য নেতাদের উপর নির্ভর করে, মোদী আর শাহ সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত। এই ফলাফলে তাদের হাত থেকে শুধু পশ্চিমবঙ্গই হাতছাড়া হয়নি, জাতীয় রাজনীতিতেও এর প্রভাব পড়েছে। আর ঠিক এই কারণেই, ফল প্রকাশের পর, রাজ্যপাল হোক বা সিবিআই, বিজেপির হাতে যা অস্ত্র আছে, সেগুলো বিজেপি প্রয়োগ করে যাচ্ছে যাতে মমতা ব্যাকফুটে থাকেন। 

এই খেলারই নতুন অঙ্গ হলো পশ্চিমবঙ্গকে ত্রিখন্ডিত করার প্রস্তাব। 'জাতীয় সুরক্ষার' স্বার্থে নাকি এটা আবশ্যিক। তাই গোর্খাল্যান্ড, জঙ্গলমহল আর মধ্যভূমি নিয়ে, রাজ্যকে তিন টুকরো করার প্রস্তাব হাওয়ায় ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। বিজেপির মতে, হিমালয় থেকে সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত দেশের একমাত্র রাজ্যকে তিন টুকরো করে দিলেই নাকি 'অপুত্রকের পুত্র হবে আর নির্ধনের ধন, মর্তে স্বর্গসুখ, মরলে বৈকুন্ঠ গমণ' একদম নিশ্চিত। গতকাল বিজেপির এক নেতার সাথে এই বিষয়ে কথা চলাকালীন তিনি বললেন যে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে, রাজ্যকে ভেঙে, তিনটে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা নাকি আশু প্রয়োজন। আমি যখন পালটা জানতে চাইলাম যে বাংলাদেশের সাথে সীমান্ত তো আসাম আর ত্রিপুরারও আছে, সেখানেও কি একই পদক্ষেপ নেয়া হবে? তখন তার উত্তর যে ওখানকার পরিস্থিতি আলাদা।

আসলে পশ্চিমবঙ্গে পরাজয় বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা। আর যে পরিমাণ অর্থ তারা খরচ করেছে, সেটার পর মেনে নেয়াও খুব সহজ নয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা হোসপাইপে করে অর্থ ঢেলেছেন ঠিকই কিন্তু সেটা ঠিক যায়গায় পড়েছে কিনা সেটা নিয়ে তারা চোখ বুজে ছিলেন। আজ যখন চোখ খুলেছে তখন দেখছেন যে টাকাও নেই আর ক্ষমতাও নেই। কেন্দ্রে এককভাবে ৩০৩ জন সাংসদ আর খোদ এই রাজ্য থেকে ১৮ জন সাংসদ থাকলেও রাজ্যের নেতারা নিজেরা কেন্দ্রীয় নিরাপত্তার আড়ালে লুকিয়ে আছেন। নিজেদের আরামদায়ক ঘরে বসে, কর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার কথা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে বড় বড় কথা বলে আর আক্রান্তদের ছবি দেখিয়ে টাকা তুলেই তাদের দৌড়ে শেষ। রাজ্য নেতারা একে অপরের নামে বিষোদগার করে যাচ্ছেন। প্রত্যেকেরই অভিযোগ যে অন্যজন টাকা খেয়েছে। এমতাবস্থায়, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বর কাছে কুমিরের শেষ বাচ্চা হলো রাজ্য ভাগ। তারাও জানে যে দলদাসরা, সব ভুলে, আবার ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাই তো সেই নেতা অনায়াসেই বলতে পারেন যে, "লোকসভা নির্বাচন আসতে তো এখনও তিন বছর বাকি। ততদিনে সবাই সব কিছু ভুলে যাবে"।

No comments:

Post a Comment