Monday, June 20, 2022

পশ্চিমবঙ্গ দিবস ও কিছু ভাবনা

আজ সোশ্যাল মিডিয়াতে যারা 'পশ্চিমবঙ্গ দিবস' নিয়ে মাতোয়ারা হয়ে আছেন তাদের মধ্যে ক'জন এই দিনের পিছনের ঘটনাবলী থেকে শিক্ষা নিয়েছেন সেটা নিয়ে আমি সন্দিহান। না, আমি শুধু হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিভেদের কথা বলছিনা বা তাদের একত্রে বসবাসের কল্পনার কথা বলছিনা। আজ যে পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালিত হচ্ছে সেটা বাস্তবায়িত হওয়ার কারণ কিন্তু আরও গভীরে।


১৯৪৭ সালে, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির যৌথ অধিবেশনে যখন প্রথম ভোটাভুটি হয় তখন ১২০-৯০ ভোটে সিদ্ধান্ত হয় যে বাংলা অবিভক্ত থাকবে। ১৯৪৬ সালের গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস-এর কুখ্যাত নায়ক, হাসান সোহরাওয়ার্দী এবং শরৎ চন্দ্র বোসের মত ব্যক্তিরা বঙ্গ বিভাজনের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে, সওয়াল করেন অখণ্ড বাংলার পক্ষে যা ভারত ও পাকিস্তান কোন দেশেই যোগ দেবেনা। ব্যাপারটা বোঝার জন্যে আজকে কাশ্মীরের মুসলমানরা যে দাবী করছে সেটার সাথে মিলিয়ে দেখতে পারেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে তখন, আজকের হিসেবে, পশ্চিমবঙ্গের প্রায় দুই কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ৬০ লক্ষ মুসলমান অর্থাৎ প্রায় ৩০% আর পূর্ববঙ্গের প্রায় চার কোটি জনসংখ্যার মধ্যে হিন্দু ছিল দেড় কোটির মতন যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৩%।


শরৎ চন্দ্র বোস বা সোহরাওয়ার্দী'র মত কিছু নেতা বা কৃষক প্রজা পার্টির মত দল স্বতন্ত্র বাংলার প্রচার করলেও, যা আদতে আরেকটা কাশ্মীরের জন্ম দিতো এবং সেই দূরদর্শিতার কারণেই, মুসলিম লীগের দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের দাবী সত্ত্বেও জিন্না কিন্তু সোহরাওয়ার্দীর দাবীকে সমর্থন করেছিলেন। এই দূরদর্শিতা ডঃ শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায়েরও ছিল তাই তিনি ভারত ভাগের সাথে বাংলা ভাগের দাবীতে সোচ্চার হয়েছিলেন আর পাশে পেয়েছিলেন ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়, নির্মল চন্দ্র চ্যাটার্জি, স্যার যদুনাথ সরকার, ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার, ডঃ মেঘনাদ সাহা, ডঃ শিশির মিত্র, ডঃ সুনীতিকুমার চট্টপাধ্যায়, ডঃ সুরেন্দ্রনাথ মিত্র সহ আরও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের যারা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে অবিভক্ত বাংলার ছয় কোটি জনসংখ্যার পঞ্চাশ শতাংশ মুসলমান হলে সেখানে হিন্দুদের পরিণতি কি হতে পারে।


এবার আসি সেই ঘটনায় যেখান থেকে শুরু করেছিলাম এবং সেই শিক্ষা হিন্দুরা কতটা নিতে পেরেছে সেটা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলাম। লক্ষ্য করে দেখুন, সেই সময় ডঃ শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন হিন্দু মহাসভার প্রতিনিধি আর বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের প্রাদেশিক আইনসভায় ছিল কংগ্রেসের আধিপত্য। এই ভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থান কিন্তু ডঃ মুখোপাধ্যায়ের নিজের জাতিকে রক্ষা করার প্রতি বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং তিনি এবং অন্যান্য বিশিষ্টজনেরা সম্মিলিতভাবে প্রাদেশিক সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন যাতে হিন্দুদের আলাদা হোমল্যান্ড তৈরী হয়। এরই পরিণতিতে, হিন্দু বহুল অঞ্চলগুলির প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত আইনসভাতে আলাদা হোমল্যান্ড গঠনের দাবী ৫৮-২১ ভোটে জয়ী হয় এবং জন্ম নেয় পশ্চিমবঙ্গ।


আজকে যারা 'পশ্চিমবঙ্গ দিবস' পালন করছেন তাদের মধ্যে কতজনের মধ্যে জাতির স্বার্থে রাজনীতির ঊর্ধ্বে ওঠার ইচ্ছা বা ক্ষমতা আছে সেটা নিয়েই আমি সন্দিহান। সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখার কুফল বাংলাদেশের হিন্দুরা হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে। বাংলাদেশের হিন্দুদের সিংহভাগ বংশপরম্পরায় আওয়ামী লীগের সমর্থক। ফলে বিএনপি তাদের গুরুত্ব দেয়না তারা তাদের ভোটার নয় বলে আর আওয়ামী লীগের কাছে তো তারা হাতের পাঁচ। জাতির স্বার্থে রাজনীতিতে কিভাবে ব্যবহার করতে হয় সেটা ডঃ শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায় আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন এবং আমাদের যাবতীয় উদযাপন তখনই সফল হবে যখন আমরা তার প্রদর্শিত পথে চলতে পারবো।

No comments:

Post a Comment