Monday, December 21, 2020

মমতার পরিণতি

 সেলুলয়েডে সুচিত্রা সেনের পর, বাস্তবের কঠিন জমিতে, পশ্চিমবঙ্গের মহানায়িকা হবার যোগ্যতা একমাত্র মমতা ব্যানার্জীর ছিল। সিপিএমের অপশাসনের বিরুদ্ধে তাঁর দীর্ঘদিনের লড়াই এবং পরিশেষে, ২০১১ সালে, বামপন্থীদের ক্ষমতাচ্যুত করা তাঁকে সারা দেশের কাছে একটা আইকনে পরিণত করে। সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রাম নিয়ে তার আন্দোলন ঐতিহাসিক মর্যাদা পায়। আজ সিঙ্গুরে টাটা কোম্পানির প্রস্তাবিত কারখানা নিয়ে যে যতই অশ্রুপাত করুক না কেন, সেই চুক্তিতে যে all is well ছিলনা সেটা পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্টের আদেশেই স্পষ্ট হয়ে গেছে।


কিন্তু কথায় বলে যে প্রদীপের নীচেই অন্ধকার সবচেয়ে বেশী হয় আর সেই প্রথা মেনেই, সিপিএমের অপশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া মমতা ব্যানার্জী, নিজে ক্ষমতায় এসেই শুরু করলেন ক্ষমতার অপব্যবহার। সংখ্যালঘু তোষণ ও আর্থিক দুর্নীতি হয়ে উঠলো তাঁর কাজের সমার্থক। একথা অনস্বীকার্য যে ক্ষমতায় আসার চাবিকাঠি হিসাবে, মমতা ব্যানার্জী হয়তো এমন কিছু অশুভ শক্তির সাথে আপোষ করেছিলেন যার মূল্য তাঁকে, ক্ষমতায় আসার পর, কড়ায়গণ্ডায় চুকাতে হয়েছিল। ইমামভাতা, নলিয়াখালী দাঙ্গার মূল চক্রী, আহমেদ হাসান ইমরানকে রাজ্যসভার সাংসদ করা, সারদা বা রোজভ্যালীর মত চিটফান্ডগুলিকে অনৈতিক সুবিধা দেয়া, কালিয়াচকে জেহাদিদের হামলা বা জামায়েত-এর সভায় মধ্যমণি হওয়া ইত্যাদি ঘটনাচক্র সেই অশুভ আঁতাতের পরিচায়ক।

কিন্তু এত কিছুর পরেও, শুধুমাত্র মমতা ব্যানার্জীর সেই মহানায়িকা ইমেজের কারণে, জনগণ তাঁর উপর পুনরায় নিজেদের আস্থা রাখেন ২০১৬ সালের নির্বাচনে এবং শত অভিযোগ সত্ত্বেও তাঁর নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেসকে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশী আসন দিয়ে ক্ষমতাসীন করেন। সবাই আশাবাদী ছিলেন যে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের একচ্ছত্র নেত্রী এবার আগের ভুল শুধরে, নতুন ইনিংস শুরু করবেন। কিন্তু হায়, ভবি ভোলবার নয়। জীবনের প্রায় অর্ধেকটা সময় মাটিতে দাঁড়িয়ে আন্দোলন করে কাটিয়ে দেয়া মমতা ব্যানার্জী যে মাত্র পাঁচ বছর রাজসিংহাসনে বসার ও আগেপিছে লালবাতি নিয়ে চলার অভ্যাসে যে সম্পূর্ণ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন, এটা কারুর কল্পনাতেই ছিলনা।

জনবিচ্ছিন্ন মমতার নতুন অগ্রাধিকার হয়ে গেল স্বজনপোষণ। ক্ষমতার ঔদ্ধত্যে ও অযোগ্য স্তাবকদের প্ররোচনায় তিনি নিজের মাত্রা হারালেন। তিনি ভেবেছিলেন যে এই রাজ্যে তাঁর ক্ষমতার পক্ষে একমাত্র বিপদ বামপন্থীরা, তাই তিনি তাদেরকে, তাদেরই কায়দায় নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন। বিজেপিকে তিনি কখনই সেভাবে নিজের সরকারের পক্ষে বিপজ্জনক বলে মনে করেননি তার পিছনে কারণ মূলত দু'টো। ১) ২০১১ সালে, তাঁর ক্ষমতায়নের পিছনে অন্যতম শক্তি ছিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় Justice for People নামক NGO-র মাধ্যমে তাঁকে আইনি সাহায্য হোক বা দেশজুড়ে তাঁর বামবিরোধী ইমেজ গড়ে তোলা- সঙ্ঘের অবদান অপরিসীম। ২) অটল বিহারি বাজপেয়ী সরকারের শরিক ও মন্ত্রী থাকার প্রেক্ষিতে, বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বর সাথে তাঁর ব্যক্তিগত সখ্যতা।

কিন্তু ক্ষমতার গর্বে মদমত্ত মমতা ভুলে গেছিলেন যে বিজেপিতে ঘটে যাওয়া পালাবদলের ফলে তাঁর পরিচিত নেতৃত্ব চলে গেছেন পিছনের সারিতে আর উদয় হয়েছে এক নতুন জাতীয়তাবাদী মুখের, যার নাম নরেন্দ্র মোদী। মমতার পক্ষে দ্বিতীয় আঘাত ছিল তপন ঘোষের নেতৃত্বে হিন্দু সংহতির উত্থান। মমতার যেসব সংখ্যালঘু তোষণের ঘটনা বিজেপি নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে চুপচাপ মেনে নিত, সেগুলি নিয়েই সোচ্চার হলেন তপন'দা। সম্পূর্ণ বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগঠন হিসাবে, অত্যাধুনিক প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে, মমতার তোষণের কথা তপন'দা ছড়িয়ে দিতে লাগলেন দেশেবিদেশে। এর পরিণতিতে, মমতার পূর্বতন বামবিরোধী ইমেজ পরিণত হল 'জেহাদি দিদি'তে।

আজ ২০২১ সালের নির্বাচন যখন মাত্র ছয় মাস দূরে, তখন মমতা ব্যানার্জী উপলব্ধি করতে পারছেন যে তিনি কতটা নিঃসঙ্গ এবং অসহায় হয়ে পড়েছেন। বছরের পর বছর ধরে, মহরমের জন্যে দুর্গাপূজার বিসর্জন বন্ধ করে দেয়া মমতা ব্যানার্জী আজ নিজের হিন্দুত্ব প্রমাণ করার জন্যে প্রাণপাত করছেন। OBC আইনে সংশোধন করে, একটা বিশেষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বাড়তি সুবিধা দেয়া এবং সেটা নিয়ে বিভিন্ন জনসভায় গর্ব করা মমতা ব্যানার্জীর সরকার আজ কোর্টে, আত্মদীপ দ্বারা ফাইল করা জনস্বার্থ মামলায়, উত্তর দিতে পারছেন না।

মমতা ব্যানার্জী যতই কাজী নজরুল ইসলামের "একই বৃন্তে দুটি কুসুম" আউড়ান বা সেই অনুপ্রেরণাতে নিজের দলের প্রতীক বানান, তিনি বোধহয় কবির 'ভজন' কবিতাটা ভুলে গেছিলেন যেখানে কবি বলেছেন -

"চিরদিন কাহারো 
সমান নাহি যায়।
আজিকে যে রাজাধিরাজ 
কাল সে ভিক্ষা চায়।"

এই সরল সত্যটা মমতা ব্যানার্জী ভুলে গিয়েছিলেন আর তাই তাঁর মত জননেত্রীকেও, নিজের দল ও নির্বাচন পরিচালনা করার জন্যে, টাকা দিয়ে বিশেষজ্ঞ ভাড়া করতে হচ্ছে। তিনি নিজেও বুঝেছেন যে দলীয় কর্মীদের উপর তাঁর আর নিয়ন্ত্রণ নেই। পুলিশকে ব্যবহার করে তিনি যতটুকু সাম্রাজ্য রক্ষার চেষ্টা করছেন, আদর্শ নির্বাচন বিধি চালু হতেই, যখন পুলিশের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের কাছে, ভাঙন আরও বড় রূপ নেবে। মমতা ব্যানার্জীর কাছে সুযোগ ছিল পশ্চিমবঙ্গের নতুন রূপকার হবার। তাঁর কাছে সুযোগ ও যোগ্যতা - দুই-ই ছিল অথচ নিজের কর্মফলের কারণে ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে শুধু "জেহাদি দিদি" বা "সারদা রাণী" হিসাবে। এই পরিণতি তাঁর প্রাপ্য ছিলনা ঠিকই কিন্তু এই পরিণতি তিনি আর এড়াতেও পারবেন না। মমতার স্তাবকরাই এখন তাঁর ফুটো নৌকা ছেড়ে, বিজেপি জাহাজে উঠতে আগ্রহী। মমতার দলের লোকদের নিয়ে গঠিত বিজেপি ক্ষমতায় আসলে "অপুত্রকের পুত্র হবে না নির্ধনের ধন" সেই বিতর্ক যথাসময়ে উঠবে তবে মহানায়িকার নাটকের এই পর্যায়ের ড্রপসিন পড়ার মানে যবনিকাপাতের ঘন্টা বেজে গেছে।

No comments:

Post a Comment