Wednesday, May 18, 2022

বাঙালীর অস্তিত্ব

পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইদানীং যে বাঙালীবাদ অথবা বাঙালী জাতীয়তাবাদের ধুয়ো উঠছে সেটা 'অনুপ্রেরণা' মূলত রাজনৈতিক। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থানকে প্রতিহত করাই এই হঠাৎবাদের উৎস। প্রথমে এটা শুরু হয়েছিল তথাকথিত হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, কিন্তু হিন্দির বিরুদ্ধে মুখর হয়ে, উর্দুর বিরুদ্ধে মৌন থাকার চালাকিটা রাজ্যের ঘরপোড়া মানুষ বুঝে ফেলতেই এখন হিন্দি আর উর্দু- উভয়কেই নিশানা করা হচ্ছে।


কিন্তু এই তথাকথিত বাংলাপ্রেমীদের (অন্য অর্থে নেবেন না) মূল সমস্যা হল যে তাদের হিসাবে ভাষাই জাতির একমাত্র পরিচায়ক। তাই তাদের কাছে, দেশের পূর্বদিকের সীমান্তের পূর্ব ও পশ্চিমে বসবাসকারী উভয়েই বাঙালী। তাদের মনে কি কখনও প্রশ্ন জাগেনা যে উভয়পারের লোকের পরিচয় যদি বাঙালীই হবে তাহলে মাঝখানে সীমান্তটা আসলো কেন? হয়তো জাগে, কিন্তু রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা এবং কাঞ্চনমূল্যে সেই প্রশ্ন চাপা পড়ে যায়। তারা বোঝেনা বা বুঝতে চায়না যে ভাষা কখনও জাতির একমাত্র পরিচায়ক হতে পারেনা, কোন জাতির পরিচয় হল তার সংস্কৃতি। সীমান্তের পশ্চিমপারে বাঙালীদের সংস্কৃতি আর পূর্বপারে বাংলাভাষীদের সংস্কৃতি এখন আর এক নয়। সুজলা সুফলা পূর্বপারের অধিকাংশ মানুষ তাদের জন্যে এমন এক মরু সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেছেন যেটা অন্য কোন সংস্কৃতির অস্তিত্ব মেনে নিতে পারেনা। আর সেই কারণেই রামধনু হয়ে যায় রঙধনু আর বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তির মত, ঢাকাতেও ভাঙা হতে থাকে মন্দির, মূর্তি। কারণ সেটা সেই মরু সংস্কৃতি অনুসারে, হারাম।


আগেই বলেছি যে এই হঠাৎবাদের অনুপ্রেরণা ও স্পনসর যেহেতু রাজ্যের বর্তমান শাসক দল এবং একমাত্র লক্ষ্য বিজেপির অগ্রগতি রোধ করা, তাই বাজারে আরও একটা নতুন তত্ত্ব আসছে আর সেটা হল বাঙালী জাতীয়তাবাদ। বিজেপি যেহেতু হিন্দু জাতীয়তাবাদকে পুঁজি করে আন্দোলন করছে, তাই সেই আন্দোলন থেকে বাঙালীদের আলাদা করা (পড়ুন ভোট কাটা) এই নতুন দলের লক্ষ্য। আর এই লক্ষ্যে মূলত তারাই কাজ করছে যারা এতদিন বিজেপির দুয়ারে হত্যে দিয়ে পড়েছিল আর এখন সেখানে পাত্তা না পাওয়াতে তাদের মনে হয়েছে যে বিজেপিকে দিয়ে কিছু হবেনা। ভাবটা এমন যেন বিগত দশ বছরে বিজেপিই এই রাজ্যে ক্ষমতায় ছিল আর কাংলাপাহাড়িতে দুর্গাপূজা বন্ধ বা তেহট্ট হাই স্কুলে সরস্বতীপূজা বন্ধ বিজেপিই করেছে। মহরমের জন্যে বিসর্জন বন্ধ করা বা তোতোন দাস, রোহিত তাঁতিদের হত্যাও হয়েছে বিজেপি প্রশাসনের কারণে। সমুদ্রগড়ের নিরীহ ছেলেদের, শুধু রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে, গাঁজা কেসে ফাঁসিয়ে, তিন বছর ধরে আটকে রেখেছে বিজেপি প্রশাসন আর তারক বিশ্বাসকে গ্রেপ্তারও করেছিল বিজেপি প্রশাসন। এরপর হয়তো শুনবো যে ইমামভাতা আর OBC-A সংরক্ষণ আইনও বিজেপিরই অবদান। সত্যি, মানুষকে এতটা বোকা ভাবেন? ভাবতে পারেন?


শাসকদলের মদতপুষ্ট যে সংগঠনগুলি হিন্দির 'আগ্রাসন', বকলমে রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে সোচ্চার তাদের কিন্তু বাংলার সংস্কৃতি রক্ষায় আগ্রহ নেই। বাংলার ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরগুলি সংরক্ষণ করার বা বাংলার লৌকিক পরম্পরাকে তুলে ধরতে তারা বিমুখ। তাদের কাজ খালি রেলওয়ে স্টেশনের নামের বোর্ডে হিন্দির উপর কালি লাগিয়েই শেষ। যদিও একই হিন্দি আর উর্দু মমতা ব্যানার্জী'র সরকারি লেটারহেডে থাকলে তাদের কোন আপত্তি নেই, প্রতিবাদ নেই। যার নুন খাচ্ছে তারই বদনাম করবে, এতটা 'নিমক হারাম' তারা নয়।


আজ বাংলা ভাষা যেভাবে এই রাজ্যে নিজের স্থান হারাচ্ছে তার জন্যে হিন্দি বা উর্দু দায়ী নয়, দায়ী বাঙালীরা। হিন্দির আগ্রাসন যদি সত্যিই বিপজ্জনক হতো তাহলে দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যগুলি এর প্রভাবমুক্ত থাকতে পারতনা। কিন্তু ঘটনা হলো যে অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক বা কেরালাতে হিন্দি মোটেই কোন বিপদ নয়। অনুকরণ প্রিয় বাঙালী নিজেদের বিয়ের অনুষ্ঠানে ঐতিহ্যবাহী ফুলের সাজের বদলে কুন্দন জুয়েলারি পরবে, ধুতি-পাঞ্জাবির বদলে শেরওয়ানি পরবে, রেড মিটের দোহাই দিয়ে মাংস-ভাত ছেড়ে চেটেপুটে মাটন বিরিয়ানি খাবে, আর তারপর কাঁদুনি গাইবে যে সংস্কৃতি বিপন্ন। বাংলা সিনেমা আর গানের কথা তো বাদই দিলাম। যে বাংলা চলচ্চিত্র আগে বম্বের সিনেমা জগতে ছড়ি ঘোরাতো আজ সেই বাংলা চলচ্চিত্রের প্রতিনিধি হয়ে গেছে মোহতা''রা। পরিচালকের রাজনৈতিক রঙ দেখে স্থির করা হচ্ছে কোন সিনেমা নন্দনে স্থান পাবে। হিন্দি বা ইংরেজি সিনেমার যেকোন সহ-অভিনেতা আজ অভিনয়ের মাপকাঠিতে বাংলা সিনেমার অধিকাংশ শিল্পীকে বলে বলে দশ গোল দেবে।


কিছুদিন আগেই কেরালা ঘুরতে গিয়েছিলাম, সেখানে কাউকে খৈনী বা গুঠখা খেতে দেখলাম না। সাধারণ লোকেরা এখনও আপ্পাম, ইডলি বা ধোসা খুশি মনে খায়। ম্যাক ডি বা কেএফসি'র আধিপত্য নেই। রাস্তার বিভিন্ন বিজ্ঞাপনেও স্থানীয় অভিনেতাদের ছবি। একটা জাতি এমনিতেই শ্রেষ্ঠ হয়ে যায়না, তার জন্যে কয়েকটা প্রজন্মকে স্বাভিমান বোধ বজায় রাখতে হয়। বাঙালী যেদিন সেটা বুঝবে, তাকে আর সস্তার রাজনীতি করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে হবেনা।

No comments:

Post a Comment